যানজট নিরষনের কার্যকর পদ্ধতি এবং মোঃ আলীর
ইউ লুপ
(প্রিয়.কম) আমাদের
দৈনন্দিন জীবনে যানজট একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ
মানুষকেই চাকরি, ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত কাজের জন্য দিনের অনেকটা সময় বাসার বাইরে
কাটাতে হয়। সকল ক্ষেত্রেই যাতায়াতের সময় বাড়তি ঝামেলা হয়ে সামনে এসে অত্যন্ত
বেরসিকভাবে হাজির হয় এই যানজট, যা এখন অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
কিন্তু এতে করে প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে প্রচুর সময়। মানুষের সীমিত জীবনকাল থেকে
অকারণে হারিয়ে যাচ্ছে অতি মূল্যবান সময়।
আমাদের
নিজেদের উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের সময়কে বাঁচাতে। নিজেদের চিন্তাধারার
কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আমাদের দিতে পারে কিছুটা হলেও স্বস্তি।
প্রথমত,
‘আমি আগে যাবো’ এই মনোভাবের কারণে অনেক জায়গায় যানজটের সৃষ্টি হয়। উন্নত বিশ্বের
দেশগুলোর গাড়িচালকরা ট্রাফিক আইন মেনে চলে নিজের তাগিদেই। গাড়ি চালাতে চালাতে যখন
সামনে একটি সিগন্যাল আসতে যাচ্ছে তার আগেই তারা ভাবে যে লাল আলো জ্বলার সময় হয়েছে
কি? তাহলে তো থামতে হবে। আর আমাদের বাংলাদেশের সিগন্যালে লাল আলো জ্বলার পরও প্রায়
সকল গাড়িচালকদের চিন্তাটা এমন যে, এই সিগন্যালে যেভাবেই হোক যেতেই হবে। রাজধানীর
বেশিরভাগ রাজপথের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয় ট্রাফিক পুলিশ দ্বারা, সেখানে
ট্রাফিক পুলিশই রাস্তার রাজা। কারণ তার হাতের ইশারায় চলে সব যানবাহন। কিন্তু
ট্রাফিক পুলিশকেও তোয়াক্কা করেন না চালকরা। প্রায়ই রাজধানীর চৌরাস্তাগুলোতে দেখা
যায় সিগন্যালের শেষ কয়েকটি গাড়ির জন্য আশেপাশের সকলকে অনেকটা ধকল পোহাতে হয়, কারণ
সিগন্যাল বন্ধ করার পরও গাড়িগুলো এগিয়ে গেছে অনেকটা। ‘আমি আগে যাবো’ এই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সকলকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতন হতে
হবে।
আরেকটি
বিষয় হচ্ছে বাম পাশের লেন আটকে রাখা। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় গাবতলী থেকে
সোজা চলে যাওয়া মিরপুর রোডের কথা। আর মিরপুর ১ নম্বর থেকে টেকনিক্যালের দিকে
রাস্তাটি গিয়ে মিশেছে মিরপুর রোডে। এখানে প্রতিমুহূর্তে একটি ঘটনা ঘটছে। গাবতলী
থেকে সোজা যে বাসগুলো যাবে সেগুলো সিগন্যাল পার হয়েই বামপাশে থেমে যাত্রী ওঠানো
শুরু করে। যার ফলে মিরপুর ১ নম্বর থেকে আসা গাড়িগুলো আটকে পড়ে এবং তারা হর্ন
বাজাতে থাকে। কিন্তু রাস্তা আটকিয়ে যে বাসচালক যাত্রী তুলছে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ
নেই। অথচ বাসটা মাত্র দশ ফুট সামনে নিয়ে দাঁড় করালে কোনও সমস্যা হতো না। তাহলে
আটকে পড়া গাড়িগুলোকে কখনো থামতে হয় না এবং চলাচল স্বাভাবিক থাকে। যেসব রাস্তায়
বামপাশে গাড়ি যাবে সেখানে বাম পাশের লেন খালি রাখতে হবে। তাহলে একপাশের গাড়ি চলাচল
স্বাভাবিক থাকবে।
কিছুটা
সামনে এগিয়ে গেলে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। এখানে আরেকটি বিড়ম্বনা। বিশাল রাস্তার
প্রায় পুরোটাই দখল করে বাসগুলো যাত্রী ওঠানামা করছে। আর এদিকে পিছনে আটকে থাকে
অসংখ্য গাড়ি এবং ক্রমশই লাইন বাড়তে থাকে। এরপর শ্যামলী, শিশুমেলা, কলেজগেট,
আসাদগেট, শুক্রাবাদ, কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড এলাকার চিত্রও একই রকম। রাজধানীর যেসব
এলাকায় যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে এবং কিছুক্ষণ পরপর বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা
করায় সেসব এলাকার চিত্রও একই রকম। এক বাসের সাথে আরেক বাসের প্রতিযোগিতার কারণে
পেছনের বাসটিকে সামনে যেতে দেয় না বাসচালক। তার জন্য পেছনে যতই গাড়ি আটকে থাক
চালকের কোনও চিন্তাই নেই। সকল যাত্রীবাহী বাসগুলো যদি রাস্তার বাম পাশে সঠিকভাবে ও
নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য থামানো হয়, তাহলে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে সহজেই অন্য
গাড়িগুলো চলে যেতে পারে যাদের থামার কোনও প্রয়োজন নেই। বাসচালকদের এই ব্যাপারে
সচেতন হতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে তার কারণে আরও অনেকগুলো মানুষের সমস্যা হচ্ছে।
সিগন্যাল
মেনে চলা, বাম পাশের লেন খালি রাখা এবং রাস্তার একপাশে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা
করানো এই কয়েকটি বিষয়ে গাড়িচালকরা সচেতন হলে যানজটের সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে। আর
এই কাজগুলো করতে সরকারকে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাউকে কোনও অর্থ ব্যয় করতে হবে না।
প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ও কয়েকটি পদক্ষেপ এবং এগুলো সবই আমাদের ভালোর জন্য,
খারাপের জন্য নয়।
সরকার
রাজধানীর যানযট নিরসনে কয়েকটি এলাকায় উড়ালসড়ক তৈরি করেছে। সেসব এলাকায় যানজট এখন
অনেকটাই কম। এগুলো মধ্যে রয়েছে মিরপুর-কালশী থেকে এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল-বাড্ডা,
বনানী ওভারপাস। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান মোঃ হানিফ
ফ্লাইওভার। কয়েকদিন আগেও যেখানে বাসে গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ি যেতে সময় লাগতো ২
ঘণ্টা, এখন সময় লাগে সর্বোচ্চ ৮ মিনিট। তবে সরকারের প্রচেষ্টার সাথে আমাদেরও
চেষ্টা করতে হবে, নিজেদের বোঝাতে হবে।
ছোট
একটি অংক কষলেই হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরে নেয়া যাক রাজধানীর একজন সাধারণ
খেটে খাওয়া মানুষের কথা। সে তার জীবনের ৩০টি বছর কাজের সাথে যুক্ত থাকে, হোক সেটা
চাকরি বা ব্যবসা। প্রতিদিন তাকে আসা যাওয়ার পথে অতিরিক্ত ৩ ঘণ্টা যানজটে ব্যয় করতে
হয়। তাহলে সপ্তাহে ছয় দিনে ১৮ ঘণ্টা, মাসে ৭২ ঘণ্টা, বছরে ৮৬৪ ঘণ্টা এবং ৩০ বছরে
২৫৯২০ ঘণ্টা। যা দিনে হিসেব করলে হয় ১০৮০ দিন এবং বছরের হিসেব করলে হয় প্রায় ৩
বছর। একজন ব্যক্তি তার ৩০ বছরের কর্মজীবনে ৩ বছরই ব্যয় করছে অযথা রাস্তায়। এটাকে ‘অনর্থক অপচয়’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। জীবনের মূল্যবান এই দুষ্প্রাপ্য সময়কে
আমরা নিতান্তই অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি।
পৃথিবীর
সমস্ত অর্থসম্পদ একত্র করলেও হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই অমূল্য
সময়কে বাঁচাতে নিজেদের কয়েকটি বিনা খরচের উদ্যোগ হয়তো আমার আপনার জীবন থেকে
বাঁচিয়ে দেবে অনেকটা সময়।
২০১০
সালে একুশে টেলিভিশনে ঢাকা শহরের যানজট নিরসন নিয়ে স্কুলপাস ট্যাক্সিচালক মোঃ আলীর
একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। ২০১০ সালের আগে ৫ বছর ধরে রাজধানীর যানজট নিয়ে
মানুষের চরম সংকটকে উপলব্ধি করে নিজে ভেবে বের করেন একটি পদ্ধতি। তিনি ঢাকার সমস্ত
রাস্তার চিত্র অংকন করে রীতিমত তাক লাগিয়ে দেন বিশেষজ্ঞদের। তার মতে ঢাকা শহরের
যানজট হয় সিগন্যাল ও চৌরাস্তাগুলোতে। রাজধানী শহরের ৭০টি জাংশনে ‘ইউ’ লুপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে যানজট নিরসন করা সম্ভব বলে দাবি করেন তিনি। এ
পদ্ধতির অন্যতম অনুসঙ্গ হবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। তার মতে এতে সিগন্যাল বাতি আর
ট্রাফিক পুলিশের ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে।
মোঃ
আলী বলেন, আমার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করলে তিন মাসের মধ্যে যানজট কমে যাবে এবং এক
বছরের মধ্যে যানজট থাকবে না। আর এতে খুব বেশি অর্থও ব্যয় হবে না। আমি সরকারের কাছে
আমার জীবন বাজি রেখেছি, না হলে আমি ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে প্রস্তুত।
বুয়েটের
ট্রান্সপোর্টেশন বিশেষজ্ঞ ড. মু. শামছুল হক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন মোঃ আলীকে বলেন
‘গিফটেড বয়’। তিনি বলেন, প্রকৌলশীদের মেধাকেও অতিক্রম করে গেছে তার মেধা। কারণ
পাঁচ বছরের সত্যিকারের সাধনা সোজা কথা নয়। সে আমাকে বলছিলো, রাস্তায় জ্যামে পড়ে
থেকেই তার ভাবনায় আসে জ্যাম কেন হবে। এই কেনোর উত্তরটা খুঁজতে গিয়ে সে আসল
জায়গাটায় হাত দিতে পেরেছে। জাংশন, জাংশনের মধ্যে রাইট টার্নের ক্রস মুভমেন্ট। সে
যে ‘ইউ’ লুপের কথা বলেছে, সে না জেনে সত্যের কাছাকাছি গিয়েছে। কিন্তু বাইরের
প্রত্যেকটি শহরে এগুলো বাস্তবায়ন করে সাশ্রয়ী শহর বানিয়ে ফেলেছে।
বুয়েটের
এই বিশেষজ্ঞ কম্পিউটারে কাঁচপুর ব্রিজে ‘ইউ’ লুপ
পদ্ধতির প্রয়োগ করে দেখিয়ে দেন যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সেখানে কোন যানজটের
সৃষ্টি হবে না।
অস্ট্রেলিয়া,
দুবাই ও ব্যাংককসহ বিভিন্ন আধুনিক নগরীর রাস্তা যেভাবে তৈরি হয়েছে তা মোঃ আলীর
ঢাকা শহরকে তার যানজটমুক্ত করার বিশদ পরিকল্পনার সাথেও মিল রয়েছে। কিন্তু মজার
ব্যাপার হচ্ছে মোঃ আলী ঢাকা শহর ছাড়া বিশ্বের আর কোনও শহর দেখেন নি। মোঃ আলী তার
পরিকল্পনা নিয়ে পুলিশ কমিশনার, নগর ভবন, সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ আরো
অনেকের কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কেউই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগ্রহ দেখান
নি। পরবর্তীতে বাস্তবায়নের কথা ভাবা হলেও তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।
আমজনতার প্রতিনিয়ত যানজটের দুর্ভোগ কমাতে নতুন
নতুন উড়ালসড়ক তৈরি করার পাশাপাশি মোঃ আলীর ‘ইউ’ লুপ
পদ্ধতির বাস্তবায়ন করার কথা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেরিতে হলেও ভেবে দেখা
উচিৎ।
সূত্র – প্রিয়.কম।
0 comments:
Post a Comment