Tuesday, April 8, 2014

তরুণদের ভারত বিদ্বেষ মনোভাব তুঙ্গে

তরুণদের ভারত বিদ্বেষ মনোভাব তুঙ্গে
 এ হলো এক অন্যরকম উৎসব। পরাজিতের জন্য উৎসব। টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সেটাই দেখা গেল। সাধারণত নিজ দেশ বা পছন্দের দল খেলায় বিজয়ী হলে সমথর্করা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন। ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শ্রীলংকার বিজয় আর ভারতের পরাজয়ে উৎসব করছে বাংলাদেশের মানুষ। মাঠে খেলা দেখা শ্রীলংকার দর্শকরা উৎসব করেছেন নিজ দেশ বিজয়ী হওয়ায়। আর বাংলাদেশের দর্শকরা উৎসব করেছেন ভারত পরাজিত হওয়ায়। খেলার পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের তরুণরা ভারতের পরাজয়ে রাতেই আনন্দ মিছিল বের করে। আনন্দে বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগের মাধ্যমে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুদেশ ভারতের প্রতি এদেশের মানুষের যে এতো ক্ষোভ, ঘৃর্ণা টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত পরাজিত হওয়ার পর আনন্দ উৎসবেই প্রমাণ হয়। শুধু মিরপুর স্টেডিয়াম নয়, সারা ঢাকা শহর, বিভাগীয় ও জেলা শহর এমনকি উপজেলা, গ্রাম পর্যায়েও ভারতের পরাজয়ে মানুষকে উৎসব করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ভারত বিরোধিতার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে তা স্পষ্ট।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে ভারতের দাদাগিরিতে সাধারণ মানুষের মতো নতুন প্রজন্ম  চরম বিক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের কারণ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বৈরী আচরণ। দাদাগিরি করে ভারত দীর্ঘ ৪৩ বছরেও বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা দেয়নি। প্রবাদে আছে ‘আত্মীয় বদল করা যায় কিন্তু প্রতিবেশী বদল করা যায় না।’ প্রতিবেশী বন্ধু দাবি করা হলে ভারত দীর্ঘদিনেও  বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বেও কোনো নিদর্শন দেখাতে পারেনি। ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি বণ্ঠন, ফারাক্কা বাধ, টিপাইমুখে বাধ, গজলডোবা বাধ, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে করে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার পথে। ভারত ট্রানজিট ও বিদ্যুৎ ট্রানজিট নিচ্ছে। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে কোলকাতার পাশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করে বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। অথচ ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী  লীগের মধ্যে মধুর সম্পর্ক প্রচার করা হলেও তিস্তা পানি চুক্তি, সীমান্তে হত্যাকা- বন্ধ, ছিটমহল বিনিময়সহ বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কিছ্ ুহয়নি। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হলেও দীর্ঘদিনেও তিন বিঘা বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। এছাড়াও সীমান্ত হত্যা অব্যাহত রাখা এবং বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের পক্ষে দেশটির অবস্থান নেয়া তরুণ সম্প্রদায় ভালোভাবে মেনে নেয়নি। এজন্য দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব জোরদার হচ্ছে। জনগণ এবং তরুণ প্রজন্মের এ মনোভাব রাজনীতিকদের জন্য নতুন বার্তা দিচ্ছে।
লাল সবুজের ক্রিকেট দল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার শেষ নেই। দেশের ক্রিকেট দল সারাবিশ্বে লাল সবুজের পতাকা উড়াচ্ছে। আদর করে অনেকেই ক্রিকেট দলকে টাইগার ডাকেন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অশান্তির মধ্যেও মানুষ চায় অন্তত ক্রিকেট যেন রাজনীতিম্ক্তু থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলো ক্রিকেটে রাজনীতি ঢুকে গেছে। এ রাজনীতি যত না আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি তার চেয়ে বেশি শাসক দলের অভ্যন্তরীণ। বিসিবির নের্তৃত্ব কর্তৃত্ব নিয়ে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে তারা। ক্রিকেট নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তাদের মতে টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট সংগঠকরাই। গত কয়েক বছরে তারা নিজেদের নের্তৃত্ব কর্তৃত্ব নিয়ে যত মেধা ব্যয় করেছেন তার সামান্য মেধা ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ব্যয় করেননি;বরং বিভিন্ন সময় অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝামেলা বাধিয়েছেন। দেশের ক্রিকেটভক্তদের আনন্দ মাটি করেছেন। বিশ্বে ফুটবল আর ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। অবশ্য ’৯০ দশকের শেষের দিকে কোলকাতার ইডেন গার্ডেনে প্রতিপক্ষ বিজয়ী হওয়ায় ভারতীয় দর্শকরা মাঠে জুতা-পানির বোতল ছুড়ে সেই ভদ্রতার মোড়কে পানি ঢেলে দিয়েছেন।
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় ঢাকাসহ সারাদেশ পাতাকার শহরে পরিণত হয়। বিভিন্ন দেশের সমর্থকরা সে দেশের পতাকা বাসার ছাদে টানিয়ে দেন। ক্রিকেটে ঘরে ঘওে বিভিন্ন দেশের পতাকা দেখা না গেলেও ক্রিকেট ভক্তদের অনেকেই পতাকা উঠান; মাঠে খেলা দেখতে যান পছন্দের দলের পতাকা হাতে নিয়ে। খেলার সময় ফোর, সিক্স, ভিক্টোরি এবং পতাকা দেখিয়ে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেন। টি-২০ বিশ্বকাপ খেলা শুরুর পর হঠাৎ করে মাঠের দর্শকদের জন্য অন্য দেশের পতাকা বহন নিষিদ্ধ করা হয়। অংশ নেয়া দলগুলোর পতাকা বহনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর সাবেক ক্রিকেটার ও সংগঠকরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। তারপরও সংশ্লিষ্টরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। কিন্তু টি-২০ ফাইনালে দেখা গেছে ভারতের সমর্থকরা শতশত ভারতীয় পতাকা নিয়ে মিরপুর মাঠে উপস্থিত। ভারতীয় পতাকা তাই প্রশাসন নির্বিকার! আইন অমান্য করে ভারতীয় পতাকা নিয়ে খেলার মাঠে যাওয়া কোনো দর্শককে বাধা দিয়েছে বা ভারতীয় পতাকাবাহী কোনো দর্শকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন ঘটনা নেই। তাহলে খেলার মাঠে বিদেশি পতাকা বহন নিষিদ্ধ করা হলো কেন? তাহলে কী শুধু পাকিস্তান দলের সমর্থকদের ঠেকানোর জন্যই খেলার মাঠে বিদেশি পতাকা বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে? খেলার সময় দেখা গেছে ভারতের খেলোয়াড়দের নিরুৎসাহী করতে অনেক দর্শককে ‘ভুয়া ভুয়া’ ধ্বনি দিচ্ছেন। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা হওয়ার পরও খেলার মধ্যভাগে ভারত পরাজিত হচ্ছে বুঝতে পেরে বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে উদ্দীপনা বেড়ে যায়। শ্রীলংকার খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে দেখা গেল তরুণ দর্শকদের। মহেন্দ্র সিং ধোনিদের ব্যর্থতায় যেন ভারতবিদ্বেষী বাংলাদেশের তরুণদের দারুণ উজ্জীবিত করে। শ্রীলংকার বিজয় নিয়ে উৎসাহ নেই; উৎসাহ যেন ভারতের পরাজয়কে কেন্দ্র করেই। খেলা তো খেলাই। দেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন এবং যথেষ্ট অবদান রেখেছেন তাদের বিরাট অংশ ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন দেশের দলকে সমর্থন করে থাকেন। খেলার সময় তারা সেসব দেশের পতাকা উড়ান। ক্রিকেটে খেলোয়াড় ব্রায়ান লারা, শচীন টে-ুলকার, ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান এবং ফুটবলে ব্রাজিল, ইতালি, আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করেন এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে লাখ লাখ কোটি কোটি। তারা পছন্দের দল ও দেশের পতাকা বহন করেন। তাই বলে কী বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকার প্রতি তাদের দেশপ্রেমে ঘাটতি পড়ে? ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। হয়তো ক্রিকেট নিয়ে সামনে আরো উন্মাদনা হবে। কিন্তু তরুণ তরুণদের মধ্যে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব বেড়ে যাওয়ার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। দিল্লীতে বৃষ্টি হলে যারা ঢাকায় ছাতা ধরেন তাদের জন্য এটা যে অশনি সংকেত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সূত্র -স্টালিন সরকার : দৈনিক ইনকিলাব।

0 comments:

Post a Comment