সত্য জানি, সত্য মানি এবং সত্যের সাথে থাকি। সকল খবর হোক সত্য ও নিরপেক্ষ।

সত্যকে অস্বীকার কারনে, গত চার দশকে জাতি হিসাবে আমরা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারিনি । স্বাধীনতার প্রায় অধ শতাব্দীতে জাতি তার কাঙ্তিত সাফল্য পায়নি।

মোর নাম এই বলে ক্ষ্যাত হোক – আমি তোমাদেরই লোক

যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ জাতি সমৃদ্ধিলাভ করেছে - আমরা তাদের ভুলব না । তোমরা অমর হয়ে থাকবে জাতীর ভাগ্যাকাশে। আমাদের ভালবাসা ও দোয়া রইল।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষা হোক সবার জন্য উম্মুক্ত ও সহজলভ্য।

পযটন হোক – জাতীয় উন্নতির একমাত্র হাতিয়ার।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, নীলগিরি সহ হাজারো দৃষ্টি নন্দন অপার সৌন্দার্য ছড়িয়ে আছে এ জমিনে – জানি ও সমৃদ্ধ করি দেশমাতৃকাকে।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে / এছাড়াও আমরা ডোমিন- হোষ্টিং বিক্রি /আপনার সাইটের ভিজিটর বাড়ানো / সাইটিকে কে গুগল টপে আনতে আমাদের সাহায্য নিন।

Saturday, October 5, 2013

মিল্ক ভিটায় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে দুর্নীতির মহোৎসব

মিল্ক ভিটায় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে দুর্নীতির মহোৎসব

দুর্নীতির অপর নাম যেন মিল্কভিটা। যে প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা গর্ব
 করতে পারতাম তা যেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ন্যায় মৃত্যু যন্ত্রনায় চটফট করছে।

দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায়ী সদস্যদের প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটায় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা চলছে। অথচ সারা দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের স্বার্থ দেখতে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে তাদের কমিটিতে পাঠানো হয়। খামারিরা বছরের পর বছর থেকে যায় বঞ্চিত। তারা দুধের ন্যায্য মূল্য পায় না। ঘুষ না দিলে বিপদে ঋণ পায় না। অসুস্থ গবাদিপশুর সুস্থতায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা পায় না। সব মিলিয়ে যাদের দুধের ওপর নির্ভর করে মিল্ক ভিটার সব কার্যক্রম, সেই প্রান্তিক খামারিরাই চরম উপেক্ষার শিকার।

খামারিরা অভিযোগ করেছে, বর্তমানে ২৩৪ জন পশু চিকিৎসা সহকারী (এএলএফআই) থাকলেও তারা প্রয়োজনের সময় গবাদিপশুর ডাক্তারের দেখা পায় না। কেউ কেউ কখনো অসুস্থ গবাদিপশু দেখতে গেলেও টাকা ছাড়া কাজ করে না। মাঠপর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশু চিকিৎসা সহকারীদের পাওয়া যায় না। এর পরও সম্প্রতি অগ্রিম টাকা নিয়ে আরও ২০০ জন পশু চিকিৎসা সহকারী নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন কয়েকজন পরিচালক। নিয়োগ পেতে টাকা দিয়েছেন এমন একাধিক চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ করেছেন, মিল্ক ভিটা ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, বাঘাবাড়ি ও নোয়াখালী অঞ্চলের দুজন সদস্য সাম্প্রতিক নিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর। বছরে পৌনে ৭ কোটি লিটার দুধ উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানে ২৩৪ জন চিকিৎসা সহকারীই ঠিকমতো কাজ করছেন না। সেখানে আরও ২০০ জন পশু চিকিৎসা সহকারী নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়োগের অনিশ্চয়তায় যারা নিয়োগ পেতে ঘুষ দিয়েছেন সেসব মানুষের ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। দুর্নীতি দমন কমিশনে এরই মধ্যে এ নিয়ে অভিযোগ গেছে।
এদিকে, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এলাকায় একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ এর আগে তিনবার সার্ভে করা হয়। প্রতিটি সার্ভে রিপোর্টে এটি লাভজনক হবে না বলে মত দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ সার্ভে রিপোর্টে ইতিবাচক মত দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান হাসিব খান ও সদস্য বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়ার তৎপরতায় খন্দকার মোশাররফকে খুশি করতে সেখানে নতুন প্লান্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়া ১৯৭৮ সাল থেকে ২২ বছর মিল্ক ভিটায় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। সে সময় কাজ না করা, চেয়ারম্যানসহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নাজেহাল করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুই দফা চাকরিচ্যুত হন তিনি। সর্বশেষ ২০০৪ সালে তাকে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিকালে তিনি কমপ্লিমেন্টের নামে মিল্ক ভিটার লাখ লাখ টাকার প্রোডাক্ট বাইরে বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে অন্তত শত কোটি টাকার মালিক। বনানীতে বাড়ি, গাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে ফাইলও রয়েছে। গত নির্বাচনে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করান বলে অভিযুক্ত তিনি। বর্তমানে মিল্ক ভিটার অনিয়ম, লুটপাট ও অরাজকতার ক্ষেত্রে তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। গতকাল মিল্ক ভিটা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর অনেক ভুক্তভোগী পাঠক ফোন করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। ২০০৮ সালে অ্যাডহক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে মিল্ক ভিটার অফিস, পিয়ন, গাড়ি, জ্বালানি ব্যবহার করেন। এ নিয়ে ২০১০ সালে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অনিয়মের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি গত নির্বাচনের আগে ৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা মিল্ক ভিটায় জমা দেন। এরপর নির্বাচিত হয়ে পুনঃতদন্ত করিয়ে পুরো টাকা মিল্ক ভিটা থেকে তুলে নেন। বর্তমানে তার নেতৃত্বে নিয়োগ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খামারিদের প্রতি লিটার দুধের বিক্রয়মূল্য থেকে ৪০ পয়সা করে কেটে রাখা হয়। এটি সমবায়ী কৃষকদের আপদকালীন সময়ে গাভী কেনার ঋণের জন্য নেওয়া হয়। বর্তমানে ৮ কোটি টাকা তহবিলে আছে। কিন্তু ঘুষ না দিলে ঋণ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন খামারিরা। অন্যদিকে চেয়ারম্যান, পরিচালক, তাদের আত্দীয়স্বজন ও প্রভাবশালীদের স্বার্থে মডেল ফার্ম নামে প্রকল্প করে অনেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, এসব নিয়োগ অনিয়ম ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক কেনাবেচায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মিল্ক ভিটার সর্বশেষ একটি তদন্ত প্রতিবেদনে অনুমোদনহীন খাতে টাকা ব্যয়, এক বিল দুবার পরিশোধের মাধ্যমে টাকা আত্দসাৎ, এমনকি প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কেনার ঘটনা ঘটেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার জন্য ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদিত ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রথম ১০ মাসেই ব্যয় করেছে ১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার চারটি গাড়ির চার জোড়া টায়ার কিনতে রহিমআফরোজকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৪০ টাকা দেওয়া হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে একই বিলের আওতায় একই পরিমাণ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নথি জালিয়াতির মাধ্যমে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান ওই অর্থ আত্দসাৎ করেছেন। মিল্ক ভিটা ২০১১-১২ অর্থবছরে জনতা কেমিক্যালের কাছ থেকে নাইট্রিক এসিড কিনেছে ৭০ টাকা কেজি দরে। মিল্ক ভিটার প্রতিযোগী দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ একই কোম্পানির কাছ থেকে নাইট্রিক এসিড কেনে ৬০ ও ৬১ টাকা কেজি দরে। এতে মিল্ক ভিটার আর্থিক ক্ষতি হয়, ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাণ-আরএফএল প্রতি কেজি ইথাইল অ্যালকোহল কেনে ২৪৩ টাকা ৯০ পয়সা দরে। মিল্ক ভিটা কেনে ৪৩৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এতে মিল্ক ভিটার ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় প্রতিটি কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মিল্ক ভিটার ১০৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতনের বিপরীতে ৮০ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির ১০ সদস্যকে ৭২ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের অগ্রিম পরবর্তীতে সম্মানী হিসেবে সমন্বয় করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেতনের বিপরীতে অগ্রিম দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। আগের অগ্রিম আদায় হওয়ার আগেই একই ব্যক্তিকে আবার অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়ম বর্তমান চেয়ারম্যানের অনুমোদনে করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র - শিমুল মাহমুদ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বাংলাদেশ বিমানের ঘাটে ঘাটে লুটপাট

বিমানের ঘাটে ঘাটে লুটপাট - রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে।

বড় লজ্জা লাগে - আসলে কি আমরা দেশ প্রেমিক  -  রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে।  বাংলাদেশ বিমানের ১০ বিভাগের ২৯ পর্যায়ে প্রতি মাসেই শত কোটি টাকার লুটপাট চলছে। শ্রমিক লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই এসব লুটপাটের অন্যতম হোতা। আধুনিক নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও সেসব লুটপাটের ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, এসব লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি ফি বছর লোকসানের ঘানি টানলেও বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন। বাড়ি-গাড়ি, শানশওকতের কোনো কমতি নেই তাদের। লুটপাটের টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও বণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা বরাবরই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিমানের মতিঝিল সেল্স অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, সম্ভার ও ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও ডিউটি রোস্টার শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন ও লুটপাট ঘটে থাকে। তবে বিমানের সিট রিজার্ভেশনের নামে চলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির কার্যকলাপ। সিট রিজার্ভেশন শাখায় এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিমানের ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজার্ভেশন শাখায় এই সিন্ডিকেট রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের খপ্পরে অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের নামে কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন সিস্টেম (সিআরএস) প্রোভাইডারকে ১৪০ কোটি টাকা বিল পরিশোধে বাধ্য হয়েছে বিমান। সরকারি অডিটেও এ বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ওই অডিটে বলা হয়েছে, যদি সিন্ডিকেট না থাকত তাহলে রিজার্ভেশন প্রোভাইডারের সর্বোচ্চ বিল হতো মাত্র ৬ কোটি টাকা। সম্ভার ও ক্রয় বিভাগে যে কোনো ধরনের মালামাল আসামাত্র সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন দিতে হচ্ছে। এ খাত থেকে সিবিএসহ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘাটে ঘাটে শুধু মাসহারা আর চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, লাগামহীন দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে বিমানে। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালনা, লোকবল নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন লুটপাট। কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য, কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইন্স যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমানকে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এ নিয়ে টানা তিন বছর লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, সব মিলিয়ে ৬ বছরে জমা হওয়া ৯৬২টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এসব অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬৮ টাকা। এদিকে, বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের দায়ে প্রায় ৩৫০টি মামলা রয়েছে বিমানের বিরুদ্ধে। এত মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। আবার এসব মামলা চালানোর নামে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
ওভারটাইমে লুটপাট : রোস্টার তৈরিতে চাঁদাবাজি : শ্রমিক-কর্মচারীদের ওভারটাইমের নামে আরেক হরিলুটের মচ্ছব চলছে বাংলাদেশ বিমানে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওভারটাইম খাতে বিমানকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। আগের বছরও এর পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। শিফটিং ডিউটি চালু করায় এ ক্ষতি চলতি বছর ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। জানা গেছে, যানবাহন শাখায় কর্মরত একজন ড্রাইভার প্রতি মাসে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজারের চেয়েও বেশি বেতন পকেটস্থ করছেন। ওভারটাইমের অজুহাতে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। একজন ড্রাইভার দিনে ২-৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পাচ্ছেন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে বিমানে কর্মরত সর্বনিম্ন স্কেলধারী (গ্রুপ-৩-১) একজন লোডারের বেতন স্কেল হচ্ছে ১৪ হাজার ২৫০ টাকা, অথচ মাসে ওভারটাইম ও বিভিন্ন ভাতাসহ তিনি বেতন উঠাচ্ছেন ৫৪ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৭০ টাকার স্কেলধারী (গ্রুপ-৫) শ্রমিক (সুপারভাইজার) মাসে বেতন তুলে নিচ্ছেন ১ লাখ ২ হাজার টাকা। এসবই সম্ভব হচ্ছে শুধু ওভারটাইম বিলের কল্যাণে। ওভারটাইমের নামে বিমানের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও এর বড় একটি অংশ যায় শ্রমিক নেতাদেরই পকেটে। বিমান কর্তৃপক্ষ ঢালাওভাবে চলা এই ওভারটাইম প্রথা বন্ধ করতে একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ওভারটাইম যথাসময়ে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে নতুন এমডি কেভিন স্টিল বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) চালু করেন। কিন্তু কতিপয় শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে একদল দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বিমানের গেটে গেটে স্থাপিত বেশ কয়েকটি বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) ভাঙচুর ও বিকল করে দিয়েছে। কারণ এটা থাকলে তাদের লুটপাট ও ওভারটাইম জালিয়াতি সম্ভব হবে না। সংস্থার বিভিন্ন দফতরে স্থাপিত ৩০টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটি মেশিনে সুপার গ্লু ঢুকিয়ে অকার্যকর করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা বা অতিরিক্ত ডিউটি করাসংক্রান্ত কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে চাঁদাবাজ চক্রটি পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে।
বিমানের কার্গো বিভাগের রপ্তানি শাখার স্পেস কন্ট্রোল, কার্গো ওজন চেকিং, কার্গো আমদানি শাখার মেইন ওয়্যার হাউস, ডেলিভারি গেট ও কার্গো প্রসিডিউস শাখায় শ্রমিকদের ডিউটি রোস্টারের নামে প্রতিদিন গড়ে ৮ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শ্রমিক লীগের সিবিএ নেতারা এসব শাখায় নিজদের নামে ডিউটি নিয়ে সে কাজ সাধারণ শ্রমিকদের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেন। বিমানের এয়ারপোর্ট ট্রাফিক শাখার পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটে (পিসিইউ) পোস্টিং নিতে হলে প্রত্যেক স্টাফকে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই ইউনিটে পোস্টিং নিয়ে বিমানের একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৫-৭ হাজার টাকা পকেটস্থ করতে পারেন। চোরাচালানের সংস্পর্শে গেলে এর পরিমাণ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। যে কারণে বিমানের ট্রাফিক বিভাগের অধিকাংশ সদস্যের ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
বিমানের চেকিং কাউন্টারে বিভিন্ন ফ্লাইটে গমনকারী যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগেজ মাশুল আদায়ের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কর্মীরা। বাস্তবে এই টাকা বিমানের কোষাগারেও জমা হচ্ছে না। একইভাবে হারানো ও প্রাপ্তি শাখায় নিজদের কর্মী পোস্টিং দিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ পুরোটাই গায়েব করে দিচ্ছে। বিমানের বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটে খাবার পরিবেশনের নামেই প্রতি বছর গড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, একদিকে বিমান যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মানহীন-রুচিহীন আর অস্বাস্থ্যকর খাবার, অন্যদিকে অতিরিক্ত খাবারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। বিমানের বিএফসিসির খাবার নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে। খাবারের মান খারাপ থাকায় প্রধানমন্ত্রী আবুধাবি যাওয়ার সময় বিমানের দেওয়া খাবার পর্যন্ত খাননি। ওই ফ্লাইটের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক রিপোর্টে বলেছেন, ওই ফ্লাইটের ভিভিআইপির জন্য বিএফসিসির দেওয়া আলু-পরোটা ছিল খাবারের অনুপযুক্ত। পরোটাগুলো এতটাই শক্ত ছিল যে সেগুলো খাবারের উপযুক্ত ছিল না। নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণ করতে চান না, এমনকি বাংলাদেশিরাও নন।
সর্বত্র চাঁদাবাজি-মাসহারা : বিমানের প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘাটে ঘাটে মাসহারা দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগের জন্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে সিবিএকে। প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ কারণে সম্প্রতি এক নিয়োগে কমপক্ষে ১০ জন জামায়াতে ইসলামীর রোকন, শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি, অর্থ সম্পাদকসহ দুটি হত্যা মামলার আসামি একজন এয়ার হোস্টেজ নিয়োগ পেয়ে যান বিমানে। বিদেশে পোস্টিং দিয়েও প্রভাবশালী চক্রটি প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি পকেটে ঢোকাচ্ছে। বিমানের ভাড়া গাড়ির ঠিকাদার ও মালিকদের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এ কাজে সিবিএকে সহযোগিতা করছেন বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ভোয়া) একজন শীর্ষ নেতা। তার তত্ত্বাবধানে সিবিএ নামধারী গাড়ির চালকরা এই চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। শুধু বেশি দামে ভাড়া নয়, গাড়িগুলোর জন্য আনলিমিটেড জ্বালানি দিচ্ছে বিমান। এই জ্বালানি তেল কেনার নামেও কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিমানের নয়া এমডি, সিইও জন কেভিন স্টিল জানান, তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংঘটিত ঘটনাবলি এরই মধ্যে দুদক তদন্ত করে দেখছে। বর্তমানে সব কটি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি রোধে কঠোর তদারকি চলছে। পরিস্থিতি অল্প সময়েই পাল্টে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জন কেভিন স্টিল।

সূত্র -  সাঈদুর রহমান রিমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন.

Wednesday, October 2, 2013

এরশাদের নতুন ফর্মুলা - নির্বাচন পদ্ধতি

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এরশাদের নতুন ফর্মুলা
 ভোটে কালো টাকার ছড়াছড়ি আর মাস্তানির দৌরাত্ম্য কমানো, পরীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের এমপি নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’ নিয়ে নতুন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর ফর্মুলা অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পাওয়া ভোটের অনুপাতে সংসদে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে এরশাদ বলেন, এতে কোনো দলের একক কোনো আধিপত্য থাকবে না; সংসদ একদলীয় হবে না। কালো টাকার ছড়াছড়ি হবে না। কেউ অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী ও মস্তানদের প্রার্থী করে ইমেজ নষ্ট করবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কোয়ালিশন সরকার গঠন করা যাবে। আবার যে দল সরকার গঠন করুক একক আধিপত্য বিস্তার করে বিরোধী দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারবে না। 
এরশাদ প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি এ রকম : জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা হবে ৩০০। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সামর্থ অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে তালিকা পেশ করবে। তালিকার সাথে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা থাকবে। এক ব্যক্তির নাম একাধিক দলের প্রার্থী তালিকায় থাকলে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। প্রত্যেক দল নির্ধারিত কোটা অনুসারে প্রার্থী তালিকা তৈরী করবে। তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব কোটা তুলে ধরেন। তার মতে সাধারণ প্রার্থী হবেন শতকরা ৫০ জন। মহিলা শতকরা ৩০, সংখ্যালঘু শতকরা ১০ এবং পেশাজীবীদের শতকরা ১০ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাধারণ প্রার্থী কোটায় যে কোনো প্রার্থী থাকতে পারবেন। পেশাজীবী কোটায় থাকবেন শিক্ষক-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-শ্রমিক নেতৃত্ব। এতে সব পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব সংসদে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন দল কোন কোটায় কত আসন লাভ করবে। যে দল সর্বাধিক ভোট পাবে, সে দলই ভগ্নাংশের সুযোগ লাভ করবে। কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করলে ৩টি আসন পাবে। ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেলে ৪টি আসন লাভ করবে। অবশিষ্ট ভগ্নাংশের যোগফলের সুবিধা সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দল ভোগ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করবেন। সে ক্ষেত্রে দলের প্রাপ্ত ভোটাধিক্য প্রথম বিবেচনা হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো দলের প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ, পদত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সংসদ সদস্য পদ হারালে ওই আসনে কোনো উপ-নির্বাচন হবে না। সংশ্লিষ্ট দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে নতুন প্রতিনিধির মনোনয়ন দেবে। নির্বাচন কমিশন তাকেই সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো দলীয় ভিত্তিতে হবে না। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এখানে সরাসরি প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। যে কোনো নির্বাচনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। 
সংবাদ সম্মেলনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানিপপের ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবর রহমান, এম এ হান্নান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, গোলাম হাবিব দুলাল, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, গোলাম কিবরিয়া টিপু, জাহাঙ্গীর মাহাম্মদ আদেল, মোস্তফা জামাল হায়দার, ফকির আশরাফ, এস এম এম আলম, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু, সাইদুর রহমান টেপা, আহসান হাবিব লিংকন, এ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম, আতিকুর রহমান আতিক, গোলাম মসিহ, মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী, এস এম মান্নান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাইদুল ইসলাম, শুনীল শুভ রায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, হাবিবুর রহমান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বাদল খন্দকার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। 
এইচ এম এরশাদ বলেন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে দলীয় শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন থাকে না। ১৯৯১ সালের সংসদে বিএনপি মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০ দশমিক ৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন আধিক্যের কারণে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। পরে জামায়াতের সেই সমর্থন সরকারের প্রতি থাকেনি। তখন আওয়ামী লীগ প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলে যায়। এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ ভোটারের রায় পাওয়া সরকার ৭০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখেও তার মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছেড়েছে। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তারা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশের রায় নিয়ে এককভাবে দেশ শাসন করেছে। আবার বিগত নির্বাচনে বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ২৯টি। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই প্রচলিত ব্যবস্থাই যে সর্বোত্তম তা নয়। এটা তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যখন দলীয় শাসন ব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও শুধু দলের ীভত্তিতে হতে পারে। ভোটাররা দলকে ভোট দেবে। সরাসরি প্রার্থীকে নয়। প্রত্যেক দল প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসনের সদস্য পাবে। তবে সদস্য পাবার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের কাস্টিং ভোটের মধ্যে ন্যূনতম ভোট পাবার সীমা থাকবে। প্রত্যেক দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থী প্যানেল তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণার মতো প্রার্থী তালিকা তৈরী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তারপর দেশে বিদ্যমান তিনশ’ আসনেই দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যে দল বেশী ভোট পাবে স্বাভাবিকভাবেই সে দল বেশী সংসদ সদস্য লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্যানেল থেকে ক্রমিক অনুসারে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করবে। যদি কোনো দল কাস্টিং ভোটের ৫০ ভাগ পেয়ে যায় তাহলে তারা ১৫০ আসন পাবে। আবার যদি কোনো দল মোট কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করে তাহলে ৩ এমপি পাবে। ওই দল তাদের প্যানেল থেকে এই ৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে দেবে। প্রাপ্ত ভোটের ভগ্নাংশের সুবিধা পাবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থী প্যানেল তৈরী করে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। যে দল ভালো প্রার্থীর প্যানেল তৈরী করবে জনগণ সেই দলের দিকেই ঝুঁকবে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করতে কোনো সন্ত্রাসী, বিতর্কিত, অরাজনৈতিক বা অযোগ্য বিত্তশালী মুর্খ প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে যাবে না। নির্বাচনী খরচ চালানোর জন্য অর্থশালীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে দলই সমালোচনার মধ্যে পড়বে। একজন সন্ত্রাসীকে প্যানেলে রাখলে গোটা দেশের নির্বাচনে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে। আর কোনো দলের ৩০০ জন প্রার্থীর প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হলেই প্যানেলভুক্ত যে কোনো প্রার্থীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে যে দল যে ক’জন সংসদ সদস্য পাবে প্যানেলের মধ্য থেকে আবার সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীদেরই সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করবে। ভোটাধিক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট করে দেবে কোন এলাকা থেকে কোন দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোনো দলের আসন শুন্য হলে দলের প্যানেল থেকেই দল শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনীত করবে। 
বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশ সমূহের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল এবং সর্বশেষ জাপান ও তুরস্কে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রণিত “সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা দেশে দেশে”- গ্রন্থে উল্লেখ আছে,  “বিশ্বের ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ হলো আইন প্রণয়নের জায়গা। এটা দেশ ও জনগণের জন্য কথা বলার জায়গা। আইন সভার সদস্য আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতিনিধি এক নয়। সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। আইন সভার সদস্য সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করতে পারেন। এমনকি তার কাছে জবাবদিহি করারও বিধান রাখা যেতে পারে। আইন সভার সদস্যের রিলিফের চাল-গম বরাদ্দ করার কাজে ব্যাস্ত থাকা সমীচীন নয়। এটা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির হাতে থাকাই উচিৎ। সংসদ সদস্যরা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। 
এরশাদ বলেন, প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার ব্যবস্থায় দলের পক্ষে জনগণের রায় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শুধুমাত্র সরাসরি ভোট প্রদান করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। জনগণের হাতে আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। দলীয় সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার-ডেপুটি স্পীকার-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-হুইপ নির্বাচিত হন। এমনকি নির্বাচনে জামানত হারানোর মতো প্রার্থীকেও দল মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে। জনগণ দলের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সুতরাং দল জনগণের রায় পাবার পর সংসদ সদস্য মনোনিত করে দিলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।  তিনি বলেন, দেশে এখন ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। গোটা জাতির সামনে এখন শুধু অন্ধকারই নয়- বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার একমাত্র কারণ-আগামী নির্বাচন। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়ে দেশের দুটিপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- এই দুটি পক্ষই গত ২২ বছর ধরে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন- মানুষকে শান্তি দিতে পারতেন- কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতেন- তাহলে কোনো কথা ছিলনা। বর্তমানে শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং জাতির সামনে চরম অরাজকতা অপেক্ষা করছে। কী করে এই পরিস্থিতি থেকে আমরা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারি- তার উপায় আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে।  আমি এটা প্রস্তাব দিলাম। এখন জনমত গঠন করা উচিত।
সূত্র - দৈ. ইনকিলাব।

নগ্ন হস্তক্ষেপ জনপ্রশাসনের ওপর

জনপ্রশাসনের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ

গত ২৬ সেপ্টেম্বর। সকালবেলা একটি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ও খবর দেখে ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। ছবিটিতে  রয়েছেন উত্তোলিত তর্জনী দিয়ে হুমকি প্রদানরত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং এর নিচেই তাঁর বক্তব্য—‘সরকারের কর্মকর্তারা নির্দেশ না মানলে কপালে দুঃখ আছে। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, তাঁরা সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন। সরকারের কথা অনুযায়ী তাঁদের চলতে হবে। যাঁরা নির্দেশ মানবেন না, তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

কাটুন: তুলিপ্রশাসনে এ ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ বা সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের নির্লজ্জ হুমকি প্রদানের নজির আমি আগে কখনো দেখিনি। ভাষা ব্যবহারেও এ কী দৈন্য, এ কী মানসিকতা, এ কী বিচারবুদ্ধিহীনতা! সরকারি কর্মকর্তারা কি কারও বাসার চাকর? হুকুম না মানলে ঘরে ফেরত? আর কার হুকুম? কিসের হুকুম?
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর মুখ্য সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন হয়েছে—কোন অধিকারে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারি কর্মকর্তাদের এজাতীয় কথা বলেন? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সঙ্গে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা বিস্মৃত হয়ে তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তা থেকে জনমনে এই ধারণাই জন্মাবে যে তিনি দলীয় নির্দেশকেই সরকারি নির্দেশ বলে মনে করছেন। তাঁর তো কোনো সরকারি অবস্থানই নেই। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রশাসক সম্মেলনে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ের নীতিনির্ধারক যেসব কথা বলেছেন, তাতে পরস্ফুিট হয়েছে, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কী ধরনের কার্যক্রম এবং কী প্রকারের ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ আশা করা হচ্ছে। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তেই প্রশ্ন উঠেছে—তাঁর (জনাব নাসিমের) এই বক্তব্য কি তাঁর এবং সম্ভবত তাঁর দলের অন্তর্নিহিত ভীতিসঞ্জাত, যে প্রয়োজনের সময়ে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের নির্দেশ অনুসারে চলবেন না? তিনি কি আরেকটি ‘জনতার মঞ্চের’ ভয়ে শঙ্কাকুল?
এই বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবার সরকারি দলের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
বস্তুত, এটা আজ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, অনুগ্রহ প্রদান, তোষণ-পোষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে যেনতেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করিয়ে দিতে চায়। এই বদমতলবে রেফারি হিসেবে জোগান দিতে রয়েছে একটি নির্বাচনী কমিশন, যার ওপর গণমানুষের আস্থা নেই—যাকে অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন ও আজ্ঞাবহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, সাধারণ নির্বাচনের মূল কাজ করবেন নির্বাহী কর্মকর্তারা, ডিসি বা এডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, আর প্রিসাইডিং-পোলিং কর্মকর্তা হবেন আনুগত্য-পরীক্ষিত সরকারি বা আধা সরকারি কর্মচারী, যাঁদের সরকারি দলের আদেশ অনুসারে কাজ না করলে ‘বাড়ি চলে যেতে হবে’—তাদের কপালে থাকবে দুঃখ। এই সংকটাকীর্ণ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নিরপেক্ষ থাকবেন, এ আশা করা অসম্ভব। প্রশাসনে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, ডিসিরা বর্তমান অবস্থায় (অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায়) রিটার্নিং কর্মকর্তা হলে নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। কোনো অবস্থাতেই সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতিরেকে কোনো সাধারণ নির্বাচন সম্ভব হবে না, কেননা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সে জন্যই এটাই সবচেয়ে জরুরি যে সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে, তাঁদের দিয়ে সরকারদলীয় নির্দেশ পালন করানো নয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যে নির্দেশ দিলেন, তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এতে একজন নাগরিক হিসেবেই শুধু নয়, একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমি সংক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। অপমানিত বোধ করেছি। আমার বিশ্বাস, সাবেক ও বর্তমান সব সরকারি কর্মকর্তা এভাবেই বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বজনাব অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী, প্রশাসন, জ্বালানি ও অর্থ উপদেষ্টাত্রয় এবং এবংবিধ অনেকেই এই আওতায়ই পড়ছেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, দেশের প্রশাসকদের অবজ্ঞা করে, নিষ্পেষিত করে, ভয় দেখিয়ে যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজেদের মতলব আদায় করতে চায়, তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়, তাহলে তো সারা দেশকেই পঙ্গু এবং নিষ্কর্মা করে তোলা হবে। বহু বছর ধরে ‘গণতন্ত্রে’র নামে সরকারি প্রশাসনব্যবস্থার ওপর এ ধরনের আঘাত আসছে। তাই প্রশাসনব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত—তাদের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অথচ সার্থক গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে আস্থাভাজন, নির্দলীয় ও কর্মক্ষম প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে আমি ‘প্রশাসনের প্রহসন, না প্রহসনের প্রশাসন’—এই শীর্ষ নামে প্রথম আলোতে ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমার একটি বক্তব্য ছিল—‘আইনের শাসনের কাঠামো কয়েকটি নীতিভিত্তিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। একে একে সব স্তম্ভ যেন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণের শেষ নেই।’ ক্রম-নিম্নগামী বিবর্তন বর্তমানে প্রশাসনকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা পরম নিরাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক। সম্প্রতি একজন সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশপ্রধান (জনাব শাহজাহান) মন্তব্য করেছেন—‘দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই।’
উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি উদাহরণসহ বিবৃত করেছিলাম, ব্রিটিশরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক দস্যুবৃত্তি এবং পরস্বাপহরণ করলেও তারা একটি সুন্দর প্রশাসনিক কাঠামো সাবেক কলোনিগুলোতে সৃষ্টি করে গিয়েছিল, যা ফলপ্রসূ কর্মদক্ষতায়, আইননির্ভর বস্তুনিষ্ঠতায় এবং নীতিনিষ্ঠ নিরপেক্ষতায় বিভূষিত। অধ্যাপক সিরিল স্মিথের মতে, এই প্রশাসনিক উৎকর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ‘ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’—অর্থাৎ বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়া দুর্ভাগ্যবশত স্বার্থপ্রণোদিত পরিবর্তন সাধন এবং ফরমায়েশি কাটছাঁট করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং কিছুটা শ্রীলঙ্কায় প্রশাসনব্যবস্থা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে হয়েছে এর চরম দুরবস্থা। অথচ মোগল-প্রশাসনিক ব্যবস্থার রেশ ধরে স্থাপিত কাঠামোর সুবিন্যস্তকরণ ও উৎকর্ষ সাধন করে যে ব্যবস্থা ব্রিটিশরা চালু করে গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক পরিবেশে তার বিকাশ সাধন করে প্রতিবেশী ভারত তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যথেষ্ট নির্দলীয়, মেধাভিত্তিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মক্ষম করে তুলতে পেরেছে। আর আমরা বাংলাদেশে কী করেছি?
গণতন্ত্রায়ণের নামে আমরা প্রশাসনে নিয়ে এসেছি সম্পূর্ণ দলীয়করণ। ভেঙে দিয়েছি তার ঋজু ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মনোভাব ও ক্ষমতা। পদ-নিয়োগকে করেছি কোটাভিত্তিক, অনুগ্রহনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদোন্নতি ও পদায়ন হচ্ছে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত তুষ্টিসাধনের ক্ষমতা যাচাই করে। ইদানীং তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পূর্বঘোষণা দিয়েই করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মেধার সম্মান-প্রদান ও স্বীকৃতি নেই। তুলনামূলকভাবে তাদের আর্থিক পরিতোষণ ও নিয়মানুগতভাবে অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানও অত্যন্ত সীমিত। সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মসম্মানবোধকেও বারবার করা হচ্ছে কশাঘাত। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যদি (যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনও অন্তর্ভুক্ত) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও কর্মক্ষম রাখা যেত, তাহলে বর্তমানে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই হতো না। রাজনৈতিক সংকটাবস্থায় জনগণ প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে পারত।
প্রশাসনের ক্রমাবনতি, এর স্খলন ও বিচ্যুতির জন্য মুখ্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। ব্রিটিশ প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার বিধান ছিল। এমনকি ‘সরকারপক্ষের’ অনুকূলে অনৈতিক বা আইনকানুন রীতিবিহর্গিত কাজ করা ছিল অপরাধ। ভারতে এখনো এবং পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে এই ব্যবস্থাই চালু ছিল। ভাষা-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা কারাবরণ কোনো বাঙালি চাকরিপ্রত্যাশীর নিয়োগপ্রাপ্তিতে অন্তরায় হয়নি। কিন্তু কোনো কর্মকর্তারই যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা সংসর্গ অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভারতে বা পাকিস্তানে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কোনো আইএনএ সদস্যকে সরকারি কাজে নিযুক্তি দান করা হয়নি (যদিও তাদের অন্যবিধ সম্মান-স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল) রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে। নিয়মকানুনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করার প্রবণতাকে দমন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যের একাংশের উদ্ধৃতি দিতে চাইছি। তিনি বলেছেন, ‘অপরাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে রাষ্ট্র ও দলকে আলাদা করতে হবে। দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কোন বাংলাদেশ উপহার দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দলীয় অনুষ্ঠান হয়। তাহলে দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য থাকে কীভাবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লোভের সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। ফ্ল্যাট, পদ, ক্ষমতার লোভে শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার—সবাই আজ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
‘শুধু রাজনীতিই নয়, দলের লেজুড়বৃত্তি করছেন, কখনো বিবেক সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ক্যাডারের ভূমিকায়।...এখান থেকে বের হওয়ার পথ দরকার। না হলে সমাজ অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।’ অনুগ্রহ বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে (একান্ত বৈঠকের জন্য) ১৪০ জন সফরসঙ্গী যদি নেওয়া হয়, তাহলে তো তা সম্ভব হবে না। সর্বক্ষেত্রে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্যই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে তীক্ষ নজরদারি যে অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি এই নিবন্ধের পরিসমাপ্তি টানছি (বিষয়টি অবশ্য আরও আলোচনার দাবি রাখে) প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে—‘সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ব্যক্তিবিশেষ, কোনো পরিবার বা অন্য কারও আজ্ঞাবহ দাস নন। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন নিজ গুণে রিপাবলিকের সেবক হিসেবে। তাঁদের অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।
সূত্র - দৈনিক প্রথম আলো