বিমানের ঘাটে ঘাটে লুটপাট - রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে।
বড় লজ্জা লাগে - আসলে কি আমরা দেশ প্রেমিক - রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে। বাংলাদেশ বিমানের ১০ বিভাগের ২৯ পর্যায়ে প্রতি মাসেই শত কোটি টাকার লুটপাট চলছে। শ্রমিক লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই এসব লুটপাটের অন্যতম হোতা। আধুনিক নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও সেসব লুটপাটের ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, এসব লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি ফি বছর লোকসানের ঘানি টানলেও বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন। বাড়ি-গাড়ি, শানশওকতের কোনো কমতি নেই তাদের। লুটপাটের টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও বণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা বরাবরই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিমানের মতিঝিল সেল্স অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, সম্ভার ও ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও ডিউটি রোস্টার শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন ও লুটপাট ঘটে থাকে। তবে বিমানের সিট রিজার্ভেশনের নামে চলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির কার্যকলাপ। সিট রিজার্ভেশন শাখায় এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিমানের ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজার্ভেশন শাখায় এই সিন্ডিকেট রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের খপ্পরে অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের নামে কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন সিস্টেম (সিআরএস) প্রোভাইডারকে ১৪০ কোটি টাকা বিল পরিশোধে বাধ্য হয়েছে বিমান। সরকারি অডিটেও এ বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ওই অডিটে বলা হয়েছে, যদি সিন্ডিকেট না থাকত তাহলে রিজার্ভেশন প্রোভাইডারের সর্বোচ্চ বিল হতো মাত্র ৬ কোটি টাকা। সম্ভার ও ক্রয় বিভাগে যে কোনো ধরনের মালামাল আসামাত্র সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন দিতে হচ্ছে। এ খাত থেকে সিবিএসহ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘাটে ঘাটে শুধু মাসহারা আর চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, লাগামহীন দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে বিমানে। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালনা, লোকবল নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন লুটপাট। কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য, কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইন্স যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমানকে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এ নিয়ে টানা তিন বছর লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, সব মিলিয়ে ৬ বছরে জমা হওয়া ৯৬২টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এসব অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬৮ টাকা। এদিকে, বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের দায়ে প্রায় ৩৫০টি মামলা রয়েছে বিমানের বিরুদ্ধে। এত মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। আবার এসব মামলা চালানোর নামে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
ওভারটাইমে লুটপাট : রোস্টার তৈরিতে চাঁদাবাজি : শ্রমিক-কর্মচারীদের ওভারটাইমের নামে আরেক হরিলুটের মচ্ছব চলছে বাংলাদেশ বিমানে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওভারটাইম খাতে বিমানকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। আগের বছরও এর পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। শিফটিং ডিউটি চালু করায় এ ক্ষতি চলতি বছর ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। জানা গেছে, যানবাহন শাখায় কর্মরত একজন ড্রাইভার প্রতি মাসে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজারের চেয়েও বেশি বেতন পকেটস্থ করছেন। ওভারটাইমের অজুহাতে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। একজন ড্রাইভার দিনে ২-৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পাচ্ছেন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে বিমানে কর্মরত সর্বনিম্ন স্কেলধারী (গ্রুপ-৩-১) একজন লোডারের বেতন স্কেল হচ্ছে ১৪ হাজার ২৫০ টাকা, অথচ মাসে ওভারটাইম ও বিভিন্ন ভাতাসহ তিনি বেতন উঠাচ্ছেন ৫৪ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৭০ টাকার স্কেলধারী (গ্রুপ-৫) শ্রমিক (সুপারভাইজার) মাসে বেতন তুলে নিচ্ছেন ১ লাখ ২ হাজার টাকা। এসবই সম্ভব হচ্ছে শুধু ওভারটাইম বিলের কল্যাণে। ওভারটাইমের নামে বিমানের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও এর বড় একটি অংশ যায় শ্রমিক নেতাদেরই পকেটে। বিমান কর্তৃপক্ষ ঢালাওভাবে চলা এই ওভারটাইম প্রথা বন্ধ করতে একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ওভারটাইম যথাসময়ে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে নতুন এমডি কেভিন স্টিল বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) চালু করেন। কিন্তু কতিপয় শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে একদল দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বিমানের গেটে গেটে স্থাপিত বেশ কয়েকটি বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) ভাঙচুর ও বিকল করে দিয়েছে। কারণ এটা থাকলে তাদের লুটপাট ও ওভারটাইম জালিয়াতি সম্ভব হবে না। সংস্থার বিভিন্ন দফতরে স্থাপিত ৩০টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটি মেশিনে সুপার গ্লু ঢুকিয়ে অকার্যকর করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা বা অতিরিক্ত ডিউটি করাসংক্রান্ত কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে চাঁদাবাজ চক্রটি পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে।
বিমানের কার্গো বিভাগের রপ্তানি শাখার স্পেস কন্ট্রোল, কার্গো ওজন চেকিং, কার্গো আমদানি শাখার মেইন ওয়্যার হাউস, ডেলিভারি গেট ও কার্গো প্রসিডিউস শাখায় শ্রমিকদের ডিউটি রোস্টারের নামে প্রতিদিন গড়ে ৮ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শ্রমিক লীগের সিবিএ নেতারা এসব শাখায় নিজদের নামে ডিউটি নিয়ে সে কাজ সাধারণ শ্রমিকদের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেন। বিমানের এয়ারপোর্ট ট্রাফিক শাখার পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটে (পিসিইউ) পোস্টিং নিতে হলে প্রত্যেক স্টাফকে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই ইউনিটে পোস্টিং নিয়ে বিমানের একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৫-৭ হাজার টাকা পকেটস্থ করতে পারেন। চোরাচালানের সংস্পর্শে গেলে এর পরিমাণ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। যে কারণে বিমানের ট্রাফিক বিভাগের অধিকাংশ সদস্যের ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
বিমানের চেকিং কাউন্টারে বিভিন্ন ফ্লাইটে গমনকারী যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগেজ মাশুল আদায়ের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কর্মীরা। বাস্তবে এই টাকা বিমানের কোষাগারেও জমা হচ্ছে না। একইভাবে হারানো ও প্রাপ্তি শাখায় নিজদের কর্মী পোস্টিং দিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ পুরোটাই গায়েব করে দিচ্ছে। বিমানের বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটে খাবার পরিবেশনের নামেই প্রতি বছর গড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, একদিকে বিমান যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মানহীন-রুচিহীন আর অস্বাস্থ্যকর খাবার, অন্যদিকে অতিরিক্ত খাবারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। বিমানের বিএফসিসির খাবার নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে। খাবারের মান খারাপ থাকায় প্রধানমন্ত্রী আবুধাবি যাওয়ার সময় বিমানের দেওয়া খাবার পর্যন্ত খাননি। ওই ফ্লাইটের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক রিপোর্টে বলেছেন, ওই ফ্লাইটের ভিভিআইপির জন্য বিএফসিসির দেওয়া আলু-পরোটা ছিল খাবারের অনুপযুক্ত। পরোটাগুলো এতটাই শক্ত ছিল যে সেগুলো খাবারের উপযুক্ত ছিল না। নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণ করতে চান না, এমনকি বাংলাদেশিরাও নন।
সর্বত্র চাঁদাবাজি-মাসহারা : বিমানের প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘাটে ঘাটে মাসহারা দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগের জন্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে সিবিএকে। প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ কারণে সম্প্রতি এক নিয়োগে কমপক্ষে ১০ জন জামায়াতে ইসলামীর রোকন, শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি, অর্থ সম্পাদকসহ দুটি হত্যা মামলার আসামি একজন এয়ার হোস্টেজ নিয়োগ পেয়ে যান বিমানে। বিদেশে পোস্টিং দিয়েও প্রভাবশালী চক্রটি প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি পকেটে ঢোকাচ্ছে। বিমানের ভাড়া গাড়ির ঠিকাদার ও মালিকদের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এ কাজে সিবিএকে সহযোগিতা করছেন বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ভোয়া) একজন শীর্ষ নেতা। তার তত্ত্বাবধানে সিবিএ নামধারী গাড়ির চালকরা এই চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। শুধু বেশি দামে ভাড়া নয়, গাড়িগুলোর জন্য আনলিমিটেড জ্বালানি দিচ্ছে বিমান। এই জ্বালানি তেল কেনার নামেও কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিমানের নয়া এমডি, সিইও জন কেভিন স্টিল জানান, তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংঘটিত ঘটনাবলি এরই মধ্যে দুদক তদন্ত করে দেখছে। বর্তমানে সব কটি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি রোধে কঠোর তদারকি চলছে। পরিস্থিতি অল্প সময়েই পাল্টে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জন কেভিন স্টিল।
সূত্র - সাঈদুর রহমান রিমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন.
বড় লজ্জা লাগে - আসলে কি আমরা দেশ প্রেমিক - রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে। বাংলাদেশ বিমানের ১০ বিভাগের ২৯ পর্যায়ে প্রতি মাসেই শত কোটি টাকার লুটপাট চলছে। শ্রমিক লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই এসব লুটপাটের অন্যতম হোতা। আধুনিক নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও সেসব লুটপাটের ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, এসব লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি ফি বছর লোকসানের ঘানি টানলেও বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন। বাড়ি-গাড়ি, শানশওকতের কোনো কমতি নেই তাদের। লুটপাটের টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও বণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা বরাবরই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিমানের মতিঝিল সেল্স অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, সম্ভার ও ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও ডিউটি রোস্টার শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন ও লুটপাট ঘটে থাকে। তবে বিমানের সিট রিজার্ভেশনের নামে চলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির কার্যকলাপ। সিট রিজার্ভেশন শাখায় এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিমানের ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজার্ভেশন শাখায় এই সিন্ডিকেট রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের খপ্পরে অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের নামে কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন সিস্টেম (সিআরএস) প্রোভাইডারকে ১৪০ কোটি টাকা বিল পরিশোধে বাধ্য হয়েছে বিমান। সরকারি অডিটেও এ বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ওই অডিটে বলা হয়েছে, যদি সিন্ডিকেট না থাকত তাহলে রিজার্ভেশন প্রোভাইডারের সর্বোচ্চ বিল হতো মাত্র ৬ কোটি টাকা। সম্ভার ও ক্রয় বিভাগে যে কোনো ধরনের মালামাল আসামাত্র সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন দিতে হচ্ছে। এ খাত থেকে সিবিএসহ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘাটে ঘাটে শুধু মাসহারা আর চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, লাগামহীন দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে বিমানে। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালনা, লোকবল নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন লুটপাট। কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য, কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইন্স যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমানকে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এ নিয়ে টানা তিন বছর লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, সব মিলিয়ে ৬ বছরে জমা হওয়া ৯৬২টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এসব অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬৮ টাকা। এদিকে, বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের দায়ে প্রায় ৩৫০টি মামলা রয়েছে বিমানের বিরুদ্ধে। এত মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। আবার এসব মামলা চালানোর নামে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
ওভারটাইমে লুটপাট : রোস্টার তৈরিতে চাঁদাবাজি : শ্রমিক-কর্মচারীদের ওভারটাইমের নামে আরেক হরিলুটের মচ্ছব চলছে বাংলাদেশ বিমানে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওভারটাইম খাতে বিমানকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। আগের বছরও এর পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। শিফটিং ডিউটি চালু করায় এ ক্ষতি চলতি বছর ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। জানা গেছে, যানবাহন শাখায় কর্মরত একজন ড্রাইভার প্রতি মাসে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজারের চেয়েও বেশি বেতন পকেটস্থ করছেন। ওভারটাইমের অজুহাতে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। একজন ড্রাইভার দিনে ২-৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পাচ্ছেন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে বিমানে কর্মরত সর্বনিম্ন স্কেলধারী (গ্রুপ-৩-১) একজন লোডারের বেতন স্কেল হচ্ছে ১৪ হাজার ২৫০ টাকা, অথচ মাসে ওভারটাইম ও বিভিন্ন ভাতাসহ তিনি বেতন উঠাচ্ছেন ৫৪ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৭০ টাকার স্কেলধারী (গ্রুপ-৫) শ্রমিক (সুপারভাইজার) মাসে বেতন তুলে নিচ্ছেন ১ লাখ ২ হাজার টাকা। এসবই সম্ভব হচ্ছে শুধু ওভারটাইম বিলের কল্যাণে। ওভারটাইমের নামে বিমানের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও এর বড় একটি অংশ যায় শ্রমিক নেতাদেরই পকেটে। বিমান কর্তৃপক্ষ ঢালাওভাবে চলা এই ওভারটাইম প্রথা বন্ধ করতে একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ওভারটাইম যথাসময়ে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে নতুন এমডি কেভিন স্টিল বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) চালু করেন। কিন্তু কতিপয় শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে একদল দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বিমানের গেটে গেটে স্থাপিত বেশ কয়েকটি বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) ভাঙচুর ও বিকল করে দিয়েছে। কারণ এটা থাকলে তাদের লুটপাট ও ওভারটাইম জালিয়াতি সম্ভব হবে না। সংস্থার বিভিন্ন দফতরে স্থাপিত ৩০টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটি মেশিনে সুপার গ্লু ঢুকিয়ে অকার্যকর করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা বা অতিরিক্ত ডিউটি করাসংক্রান্ত কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে চাঁদাবাজ চক্রটি পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে।
বিমানের কার্গো বিভাগের রপ্তানি শাখার স্পেস কন্ট্রোল, কার্গো ওজন চেকিং, কার্গো আমদানি শাখার মেইন ওয়্যার হাউস, ডেলিভারি গেট ও কার্গো প্রসিডিউস শাখায় শ্রমিকদের ডিউটি রোস্টারের নামে প্রতিদিন গড়ে ৮ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শ্রমিক লীগের সিবিএ নেতারা এসব শাখায় নিজদের নামে ডিউটি নিয়ে সে কাজ সাধারণ শ্রমিকদের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেন। বিমানের এয়ারপোর্ট ট্রাফিক শাখার পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটে (পিসিইউ) পোস্টিং নিতে হলে প্রত্যেক স্টাফকে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই ইউনিটে পোস্টিং নিয়ে বিমানের একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৫-৭ হাজার টাকা পকেটস্থ করতে পারেন। চোরাচালানের সংস্পর্শে গেলে এর পরিমাণ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। যে কারণে বিমানের ট্রাফিক বিভাগের অধিকাংশ সদস্যের ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
বিমানের চেকিং কাউন্টারে বিভিন্ন ফ্লাইটে গমনকারী যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগেজ মাশুল আদায়ের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কর্মীরা। বাস্তবে এই টাকা বিমানের কোষাগারেও জমা হচ্ছে না। একইভাবে হারানো ও প্রাপ্তি শাখায় নিজদের কর্মী পোস্টিং দিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ পুরোটাই গায়েব করে দিচ্ছে। বিমানের বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটে খাবার পরিবেশনের নামেই প্রতি বছর গড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, একদিকে বিমান যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মানহীন-রুচিহীন আর অস্বাস্থ্যকর খাবার, অন্যদিকে অতিরিক্ত খাবারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। বিমানের বিএফসিসির খাবার নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে। খাবারের মান খারাপ থাকায় প্রধানমন্ত্রী আবুধাবি যাওয়ার সময় বিমানের দেওয়া খাবার পর্যন্ত খাননি। ওই ফ্লাইটের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক রিপোর্টে বলেছেন, ওই ফ্লাইটের ভিভিআইপির জন্য বিএফসিসির দেওয়া আলু-পরোটা ছিল খাবারের অনুপযুক্ত। পরোটাগুলো এতটাই শক্ত ছিল যে সেগুলো খাবারের উপযুক্ত ছিল না। নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণ করতে চান না, এমনকি বাংলাদেশিরাও নন।
সর্বত্র চাঁদাবাজি-মাসহারা : বিমানের প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘাটে ঘাটে মাসহারা দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগের জন্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে সিবিএকে। প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ কারণে সম্প্রতি এক নিয়োগে কমপক্ষে ১০ জন জামায়াতে ইসলামীর রোকন, শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি, অর্থ সম্পাদকসহ দুটি হত্যা মামলার আসামি একজন এয়ার হোস্টেজ নিয়োগ পেয়ে যান বিমানে। বিদেশে পোস্টিং দিয়েও প্রভাবশালী চক্রটি প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি পকেটে ঢোকাচ্ছে। বিমানের ভাড়া গাড়ির ঠিকাদার ও মালিকদের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এ কাজে সিবিএকে সহযোগিতা করছেন বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ভোয়া) একজন শীর্ষ নেতা। তার তত্ত্বাবধানে সিবিএ নামধারী গাড়ির চালকরা এই চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। শুধু বেশি দামে ভাড়া নয়, গাড়িগুলোর জন্য আনলিমিটেড জ্বালানি দিচ্ছে বিমান। এই জ্বালানি তেল কেনার নামেও কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিমানের নয়া এমডি, সিইও জন কেভিন স্টিল জানান, তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংঘটিত ঘটনাবলি এরই মধ্যে দুদক তদন্ত করে দেখছে। বর্তমানে সব কটি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি রোধে কঠোর তদারকি চলছে। পরিস্থিতি অল্প সময়েই পাল্টে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জন কেভিন স্টিল।
সূত্র - সাঈদুর রহমান রিমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন.
0 comments:
Post a Comment