ইরাকের কাছ থেকে আমরা যা শিখতে পারি
হাসান ফেরদৌস | আপডেট: ০১:০৩, আগস্ট ১৩, ২০১৫
গত রোববার ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি হঠাৎ এক নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি রেগেমেগে তাঁর মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজানোর কথা ঘোষণা করেছেন। জানিয়েছেন, প্রত্যেক দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী, যাঁদের মধ্যে বাঘা বাঘা মন্ত্রীরাও রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। বিভিন্ন দলের দাবিদাওয়া পূরণ করতে তাঁর মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়াতে হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আর নয়। এককথায় তিনি মন্ত্রিসভা থেকে তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একজন উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ছেঁটে ফেলেছেন এবং পার্টি ও দলভিত্তিক কোটা-ব্যবস্থা বাতিল করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্নীতির বল্গা টেনে ধরতে একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের কথাও জানিয়েছেন।
তাঁর সরকার খোঁড়া, অযোগ্য ও দুর্নীতির আখড়া—এ কথা আল-আবাদি নিজেই স্বীকার করেছেন। দেশের মানুষের শুধু নিরাপত্তা নয়, তাদের বিদ্যুতের মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে তাঁর সরকার ব্যর্থ হয়েছে, সে কথাও কবুল করেছেন। ইরাকের চলতি সরকারের অযোগ্যতা নিয়ে কোনো মহলেই কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে সে কথা খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বীকার করবেন?
তাঁর এই বোধোদয় অবশ্য আপনাআপনি থেকে উদিত হয়নি। দেশের মানুষের চাপের মুখে পড়ে হয়েছে। এক মাস ধরেই ইরাকের রাজধানীতে আল-আবাদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছিল। শুরুতে সাধারণ নাগরিক সুশীল সমাজের নেতৃত্বে এই বিক্ষোভে অংশ নেয়। ক্রমেই বিক্ষোভে উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এক এক করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাতে যোগ দেওয়া শুরু করেন। গত শুক্রবার সে বিক্ষোভ এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তাতে অধিকাংশই দেশের শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ যাদের সরকার, প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে তারাই। বাগদাদের তাহরির স্কয়ারের সেই বিক্ষোভের মূল কথা ছিল, ইরাক থেকে আমেরিকান সামরিক অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে, ১২ বছর ধরে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। এই সময় নিজেদের ভেতর হালুয়া-রুটি নিয়ে ভাগাভাগি ছাড়া শিয়াপ্রধান এই সরকার আর কী করেছে?
ইরাকে সত্যি সত্যি অর্থপূর্ণ পরিবর্তন অর্জিত হবে, এ কথা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সরকার মেনে নিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সেটি প্রথম ধাপ। ইরাকের জনগণ তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা নিজ সরকারের ওপর চাপাতে পেরেছে, এই সাফল্যকে গৌণ ভাবার কারণ নেই। যে চাপের ফলে এই সাফল্য, তাকে পূর্ণতা দিতে এখন যা দরকার তা হলো সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। পেছন দরজা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যাতে হালুয়া-রুটির রাজনীতিতে ফিরতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার দায়িত্ব অন্য কারও নয়, ইরাকি জনগণের, সে কথা দেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে।
বাংলাদেশ ইরাক নয়। কিন্তু দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবের দিক দিয়ে তার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব ভিন্ন কিছু নয়। যেকোনো দিনের পত্রিকার পাতা খুলে দেখুন। নাগরিক অভিজ্ঞতার প্রতিটি ক্ষেত্র দুর্নীতিতে আক্রান্ত। গুম, খুন ও রাহাজানি প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। পত্রিকার খবর থেকে এ কথা অজ্ঞাত থাকে না যে সরকারের ভেতরের কোনো কোনো মহল, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য এর সঙ্গে জড়িত। সিলেটে রাজন হত্যার পর টাকা হাতিয়ে খুনিকে দেশ থেকে পালাতে পুলিশ সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ আছে। সামাজিক মিডিয়ার চাপ না থাকলে ও বিদেশি তথ্যমাধ্যম খোঁজখবরে আগ্রহী না হলে, অন্য অনেক ঘটনার মতো এই অপরাধও ঢাকা পড়ে যেত।
তাঁর সরকার খোঁড়া, অযোগ্য ও দুর্নীতির আখড়া—এ কথা আল-আবাদি নিজেই স্বীকার করেছেন। দেশের মানুষের শুধু নিরাপত্তা নয়, তাদের বিদ্যুতের মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে তাঁর সরকার ব্যর্থ হয়েছে, সে কথাও কবুল করেছেন। ইরাকের চলতি সরকারের অযোগ্যতা নিয়ে কোনো মহলেই কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে সে কথা খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বীকার করবেন?
তাঁর এই বোধোদয় অবশ্য আপনাআপনি থেকে উদিত হয়নি। দেশের মানুষের চাপের মুখে পড়ে হয়েছে। এক মাস ধরেই ইরাকের রাজধানীতে আল-আবাদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছিল। শুরুতে সাধারণ নাগরিক সুশীল সমাজের নেতৃত্বে এই বিক্ষোভে অংশ নেয়। ক্রমেই বিক্ষোভে উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এক এক করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাতে যোগ দেওয়া শুরু করেন। গত শুক্রবার সে বিক্ষোভ এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তাতে অধিকাংশই দেশের শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ যাদের সরকার, প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে তারাই। বাগদাদের তাহরির স্কয়ারের সেই বিক্ষোভের মূল কথা ছিল, ইরাক থেকে আমেরিকান সামরিক অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে, ১২ বছর ধরে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়। এই সময় নিজেদের ভেতর হালুয়া-রুটি নিয়ে ভাগাভাগি ছাড়া শিয়াপ্রধান এই সরকার আর কী করেছে?
ইরাকে সত্যি সত্যি অর্থপূর্ণ পরিবর্তন অর্জিত হবে, এ কথা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সরকার মেনে নিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সেটি প্রথম ধাপ। ইরাকের জনগণ তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা নিজ সরকারের ওপর চাপাতে পেরেছে, এই সাফল্যকে গৌণ ভাবার কারণ নেই। যে চাপের ফলে এই সাফল্য, তাকে পূর্ণতা দিতে এখন যা দরকার তা হলো সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। পেছন দরজা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যাতে হালুয়া-রুটির রাজনীতিতে ফিরতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার দায়িত্ব অন্য কারও নয়, ইরাকি জনগণের, সে কথা দেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে।
বাংলাদেশ ইরাক নয়। কিন্তু দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবের দিক দিয়ে তার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব ভিন্ন কিছু নয়। যেকোনো দিনের পত্রিকার পাতা খুলে দেখুন। নাগরিক অভিজ্ঞতার প্রতিটি ক্ষেত্র দুর্নীতিতে আক্রান্ত। গুম, খুন ও রাহাজানি প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। পত্রিকার খবর থেকে এ কথা অজ্ঞাত থাকে না যে সরকারের ভেতরের কোনো কোনো মহল, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য এর সঙ্গে জড়িত। সিলেটে রাজন হত্যার পর টাকা হাতিয়ে খুনিকে দেশ থেকে পালাতে পুলিশ সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ আছে। সামাজিক মিডিয়ার চাপ না থাকলে ও বিদেশি তথ্যমাধ্যম খোঁজখবরে আগ্রহী না হলে, অন্য অনেক ঘটনার মতো এই অপরাধও ঢাকা পড়ে যেত।
ইরাকে এর চেয়েও অধিক—দম বন্ধ হয়ে আসা অবস্থা বিরাজ করছে। তা সত্ত্বেও সে দেশে প্রতিবাদ উঠেছে। সরকারি দলের সমর্থকেরাই এই প্রতিবাদের মুখ্য অংশগ্রহণকারী। এমনকি সরকারি দলের কোনো কোনো গ্রুপ ও সদস্য সে প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। খুব দুর্নীিতগ্রস্ত এমন সরকারের ভেতরেও ভালো লোক থাকেন, এ কথা তার প্রমাণ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কথা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। একের পর এক ব্লগার নিহত হচ্ছেন। শুধু যে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ তা-ই নয়, এই ব্যাপারে কোনো দায়দায়িত্ব নিতেও তারা অনাগ্রহী। অপরাধী চিহ্নিত হয়েছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানদের আগ্রাসন, তা-ও কোনো নতুন কথা নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, খোদ সরকারের ভেতরের লোক সে কাজে হাত লাগিয়েছে।
দেশের ভেতরে সত্য জানার সুযোগ কম, সত্য বলার জায়গা কম। কথা বললে কর্তৃপক্ষ হয় ‘সব মিথ্যা’ বলে তাকে বাতিল করে দিচ্ছে, নয়তো মামলার হুমকি দিয়ে ভীতির বাতাবরণ তৈরি করছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতির মূল্যায়নে আমাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে বিদেশি সূত্রের ওপর।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বাংলাদেশের এই অবনতিশীল পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদনে একাধিক সুনির্দিষ্ট ঘটনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা জানিয়েছে, বিচারবহির্ভূত গুম-খুনের জন্য সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো কোনো সদস্য জড়িত, এমন অভিযোগ তুলেছিল একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা। কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ ভিত্তিহীন তা বলেই থামেনি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলা আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার ওপর হুমকি বলেও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। অথচ এসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যে নানা রকম অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত, সে কথা তো সরকারি তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা, অথবা অতিসম্প্রতি রাজনের হত্যা নিয়ে টাকা হাতিয়ে খুনিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের জীবন হুমকির মুখে, এ কথা জানা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, গণমাধ্যমেই সে খবর বেরিয়ে এসেছে। তাহলে?
এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আরও একটি উদ্বেগজনক লক্ষণের কথা জানিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নামে সাদাপোশাকধারী লোকজন একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। জিম্মিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে, ভুলেও যেন পুলিশের কাছে বা সংবাদপত্রে এ নিয়ে টুঁ–শব্দটি না করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, অনেক গুমের ঘটনাই আমাদের গোচরের বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে সরকার নিত্যনতুন আইন করছে, যার লক্ষ্য সরকারি কর্মচারীদের সমালোচনা ঠেকানো। খাঁড়ার ঘা পড়তে পারে তা আঁচ পেয়ে, তথ্যমাধ্যম নিজেরাই সেন্সরশিপ আরোপ করা শুরু করেছে। সুশীল সমাজভুক্ত সংস্থাগুলো প্রতিবাদ করবে, তার সুযোগও সীমিত হয়ে আসছে। সুশীল সমাজের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন যে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি হয়েছে,
তাতে সরকারের নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ না করলে যেকোনো বেসরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিষদ ভেঙে সরকার নিজের পছন্দমতো প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। অন্য কথায়, নীতিমালা বানাবে সরকার; তা মানা হলো কি হলো না, তা নির্ণয়ের দায়িত্বও সরকারের। সরকারের জন্য এই বন্দোবস্ত খুব সুবিধাজনক হলেও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য তা যে খুব স্বাস্থ্যকর নয়, তা বুঝতে কাউকে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে হয় না।
শুরুতে আমি ইরাকের উদাহরণ দিয়েছিলাম, কারণ ইরাকে এর চেয়েও অধিক—দম বন্ধ হয়ে আসা অবস্থা বিরাজ করছে। তা সত্ত্বেও সে দেশে প্রতিবাদ উঠেছে। সরকারি দলের সমর্থকেরাই এই প্রতিবাদের মুখ্য অংশগ্রহণকারী। এমনকি সরকারি দলের কোনো কোনো গ্রুপ ও সদস্য সে প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। খুব দুর্নীতিগ্রস্ত এমন সরকারের ভেতরেও ভালো লোক থাকেন, এ কথা তার প্রমাণ। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আসছে। অবস্থা সামাল দিতে ব্যর্থ হলে যে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই, যারা এখন সবচেয়ে বেশি ফায়দা ভোগ করছে।
ইরাকের মানুষ জেগে উঠতে পারে, আমরা কেন পারব না?
হাসান ফেরেদৗস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
দেশের ভেতরে সত্য জানার সুযোগ কম, সত্য বলার জায়গা কম। কথা বললে কর্তৃপক্ষ হয় ‘সব মিথ্যা’ বলে তাকে বাতিল করে দিচ্ছে, নয়তো মামলার হুমকি দিয়ে ভীতির বাতাবরণ তৈরি করছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতির মূল্যায়নে আমাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে বিদেশি সূত্রের ওপর।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বাংলাদেশের এই অবনতিশীল পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদনে একাধিক সুনির্দিষ্ট ঘটনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা জানিয়েছে, বিচারবহির্ভূত গুম-খুনের জন্য সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো কোনো সদস্য জড়িত, এমন অভিযোগ তুলেছিল একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা। কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ ভিত্তিহীন তা বলেই থামেনি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলা আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার ওপর হুমকি বলেও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। অথচ এসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যে নানা রকম অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত, সে কথা তো সরকারি তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা, অথবা অতিসম্প্রতি রাজনের হত্যা নিয়ে টাকা হাতিয়ে খুনিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের জীবন হুমকির মুখে, এ কথা জানা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, গণমাধ্যমেই সে খবর বেরিয়ে এসেছে। তাহলে?
এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আরও একটি উদ্বেগজনক লক্ষণের কথা জানিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নামে সাদাপোশাকধারী লোকজন একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। জিম্মিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে, ভুলেও যেন পুলিশের কাছে বা সংবাদপত্রে এ নিয়ে টুঁ–শব্দটি না করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, অনেক গুমের ঘটনাই আমাদের গোচরের বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে সরকার নিত্যনতুন আইন করছে, যার লক্ষ্য সরকারি কর্মচারীদের সমালোচনা ঠেকানো। খাঁড়ার ঘা পড়তে পারে তা আঁচ পেয়ে, তথ্যমাধ্যম নিজেরাই সেন্সরশিপ আরোপ করা শুরু করেছে। সুশীল সমাজভুক্ত সংস্থাগুলো প্রতিবাদ করবে, তার সুযোগও সীমিত হয়ে আসছে। সুশীল সমাজের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন যে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি হয়েছে,
তাতে সরকারের নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ না করলে যেকোনো বেসরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিষদ ভেঙে সরকার নিজের পছন্দমতো প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। অন্য কথায়, নীতিমালা বানাবে সরকার; তা মানা হলো কি হলো না, তা নির্ণয়ের দায়িত্বও সরকারের। সরকারের জন্য এই বন্দোবস্ত খুব সুবিধাজনক হলেও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য তা যে খুব স্বাস্থ্যকর নয়, তা বুঝতে কাউকে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে হয় না।
শুরুতে আমি ইরাকের উদাহরণ দিয়েছিলাম, কারণ ইরাকে এর চেয়েও অধিক—দম বন্ধ হয়ে আসা অবস্থা বিরাজ করছে। তা সত্ত্বেও সে দেশে প্রতিবাদ উঠেছে। সরকারি দলের সমর্থকেরাই এই প্রতিবাদের মুখ্য অংশগ্রহণকারী। এমনকি সরকারি দলের কোনো কোনো গ্রুপ ও সদস্য সে প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। খুব দুর্নীতিগ্রস্ত এমন সরকারের ভেতরেও ভালো লোক থাকেন, এ কথা তার প্রমাণ। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আসছে। অবস্থা সামাল দিতে ব্যর্থ হলে যে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই, যারা এখন সবচেয়ে বেশি ফায়দা ভোগ করছে।
ইরাকের মানুষ জেগে উঠতে পারে, আমরা কেন পারব না?
হাসান ফেরেদৗস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
0 comments:
Post a Comment