নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এরশাদের নতুন ফর্মুলা
ভোটে কালো টাকার ছড়াছড়ি আর মাস্তানির দৌরাত্ম্য কমানো, পরীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের এমপি নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’ নিয়ে নতুন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর ফর্মুলা অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পাওয়া ভোটের অনুপাতে সংসদে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে এরশাদ বলেন, এতে কোনো দলের একক কোনো আধিপত্য থাকবে না; সংসদ একদলীয় হবে না। কালো টাকার ছড়াছড়ি হবে না। কেউ অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী ও মস্তানদের প্রার্থী করে ইমেজ নষ্ট করবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কোয়ালিশন সরকার গঠন করা যাবে। আবার যে দল সরকার গঠন করুক একক আধিপত্য বিস্তার করে বিরোধী দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারবে না।
এরশাদ প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি এ রকম : জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা হবে ৩০০। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সামর্থ অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে তালিকা পেশ করবে। তালিকার সাথে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা থাকবে। এক ব্যক্তির নাম একাধিক দলের প্রার্থী তালিকায় থাকলে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। প্রত্যেক দল নির্ধারিত কোটা অনুসারে প্রার্থী তালিকা তৈরী করবে। তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব কোটা তুলে ধরেন। তার মতে সাধারণ প্রার্থী হবেন শতকরা ৫০ জন। মহিলা শতকরা ৩০, সংখ্যালঘু শতকরা ১০ এবং পেশাজীবীদের শতকরা ১০ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাধারণ প্রার্থী কোটায় যে কোনো প্রার্থী থাকতে পারবেন। পেশাজীবী কোটায় থাকবেন শিক্ষক-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-শ্রমিক নেতৃত্ব। এতে সব পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব সংসদে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন দল কোন কোটায় কত আসন লাভ করবে। যে দল সর্বাধিক ভোট পাবে, সে দলই ভগ্নাংশের সুযোগ লাভ করবে। কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করলে ৩টি আসন পাবে। ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেলে ৪টি আসন লাভ করবে। অবশিষ্ট ভগ্নাংশের যোগফলের সুবিধা সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দল ভোগ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করবেন। সে ক্ষেত্রে দলের প্রাপ্ত ভোটাধিক্য প্রথম বিবেচনা হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো দলের প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ, পদত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সংসদ সদস্য পদ হারালে ওই আসনে কোনো উপ-নির্বাচন হবে না। সংশ্লিষ্ট দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে নতুন প্রতিনিধির মনোনয়ন দেবে। নির্বাচন কমিশন তাকেই সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো দলীয় ভিত্তিতে হবে না। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এখানে সরাসরি প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। যে কোনো নির্বাচনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানিপপের ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবর রহমান, এম এ হান্নান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, গোলাম হাবিব দুলাল, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, গোলাম কিবরিয়া টিপু, জাহাঙ্গীর মাহাম্মদ আদেল, মোস্তফা জামাল হায়দার, ফকির আশরাফ, এস এম এম আলম, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু, সাইদুর রহমান টেপা, আহসান হাবিব লিংকন, এ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম, আতিকুর রহমান আতিক, গোলাম মসিহ, মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী, এস এম মান্নান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাইদুল ইসলাম, শুনীল শুভ রায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, হাবিবুর রহমান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বাদল খন্দকার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
এইচ এম এরশাদ বলেন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে দলীয় শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন থাকে না। ১৯৯১ সালের সংসদে বিএনপি মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০ দশমিক ৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন আধিক্যের কারণে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। পরে জামায়াতের সেই সমর্থন সরকারের প্রতি থাকেনি। তখন আওয়ামী লীগ প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলে যায়। এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ ভোটারের রায় পাওয়া সরকার ৭০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখেও তার মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছেড়েছে। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তারা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশের রায় নিয়ে এককভাবে দেশ শাসন করেছে। আবার বিগত নির্বাচনে বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ২৯টি। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই প্রচলিত ব্যবস্থাই যে সর্বোত্তম তা নয়। এটা তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যখন দলীয় শাসন ব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও শুধু দলের ীভত্তিতে হতে পারে। ভোটাররা দলকে ভোট দেবে। সরাসরি প্রার্থীকে নয়। প্রত্যেক দল প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসনের সদস্য পাবে। তবে সদস্য পাবার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের কাস্টিং ভোটের মধ্যে ন্যূনতম ভোট পাবার সীমা থাকবে। প্রত্যেক দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থী প্যানেল তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণার মতো প্রার্থী তালিকা তৈরী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তারপর দেশে বিদ্যমান তিনশ’ আসনেই দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যে দল বেশী ভোট পাবে স্বাভাবিকভাবেই সে দল বেশী সংসদ সদস্য লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্যানেল থেকে ক্রমিক অনুসারে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করবে। যদি কোনো দল কাস্টিং ভোটের ৫০ ভাগ পেয়ে যায় তাহলে তারা ১৫০ আসন পাবে। আবার যদি কোনো দল মোট কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করে তাহলে ৩ এমপি পাবে। ওই দল তাদের প্যানেল থেকে এই ৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে দেবে। প্রাপ্ত ভোটের ভগ্নাংশের সুবিধা পাবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থী প্যানেল তৈরী করে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। যে দল ভালো প্রার্থীর প্যানেল তৈরী করবে জনগণ সেই দলের দিকেই ঝুঁকবে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করতে কোনো সন্ত্রাসী, বিতর্কিত, অরাজনৈতিক বা অযোগ্য বিত্তশালী মুর্খ প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে যাবে না। নির্বাচনী খরচ চালানোর জন্য অর্থশালীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে দলই সমালোচনার মধ্যে পড়বে। একজন সন্ত্রাসীকে প্যানেলে রাখলে গোটা দেশের নির্বাচনে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে। আর কোনো দলের ৩০০ জন প্রার্থীর প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হলেই প্যানেলভুক্ত যে কোনো প্রার্থীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে যে দল যে ক’জন সংসদ সদস্য পাবে প্যানেলের মধ্য থেকে আবার সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীদেরই সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করবে। ভোটাধিক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট করে দেবে কোন এলাকা থেকে কোন দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোনো দলের আসন শুন্য হলে দলের প্যানেল থেকেই দল শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনীত করবে।
বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশ সমূহের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল এবং সর্বশেষ জাপান ও তুরস্কে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রণিত “সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা দেশে দেশে”- গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “বিশ্বের ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ হলো আইন প্রণয়নের জায়গা। এটা দেশ ও জনগণের জন্য কথা বলার জায়গা। আইন সভার সদস্য আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতিনিধি এক নয়। সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। আইন সভার সদস্য সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করতে পারেন। এমনকি তার কাছে জবাবদিহি করারও বিধান রাখা যেতে পারে। আইন সভার সদস্যের রিলিফের চাল-গম বরাদ্দ করার কাজে ব্যাস্ত থাকা সমীচীন নয়। এটা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির হাতে থাকাই উচিৎ। সংসদ সদস্যরা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।
এরশাদ বলেন, প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার ব্যবস্থায় দলের পক্ষে জনগণের রায় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শুধুমাত্র সরাসরি ভোট প্রদান করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। জনগণের হাতে আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। দলীয় সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার-ডেপুটি স্পীকার-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-হুইপ নির্বাচিত হন। এমনকি নির্বাচনে জামানত হারানোর মতো প্রার্থীকেও দল মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে। জনগণ দলের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সুতরাং দল জনগণের রায় পাবার পর সংসদ সদস্য মনোনিত করে দিলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তিনি বলেন, দেশে এখন ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। গোটা জাতির সামনে এখন শুধু অন্ধকারই নয়- বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার একমাত্র কারণ-আগামী নির্বাচন। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়ে দেশের দুটিপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- এই দুটি পক্ষই গত ২২ বছর ধরে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন- মানুষকে শান্তি দিতে পারতেন- কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতেন- তাহলে কোনো কথা ছিলনা। বর্তমানে শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং জাতির সামনে চরম অরাজকতা অপেক্ষা করছে। কী করে এই পরিস্থিতি থেকে আমরা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারি- তার উপায় আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে। আমি এটা প্রস্তাব দিলাম। এখন জনমত গঠন করা উচিত।
এরশাদ প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি এ রকম : জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা হবে ৩০০। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সামর্থ অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে তালিকা পেশ করবে। তালিকার সাথে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা থাকবে। এক ব্যক্তির নাম একাধিক দলের প্রার্থী তালিকায় থাকলে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। প্রত্যেক দল নির্ধারিত কোটা অনুসারে প্রার্থী তালিকা তৈরী করবে। তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব কোটা তুলে ধরেন। তার মতে সাধারণ প্রার্থী হবেন শতকরা ৫০ জন। মহিলা শতকরা ৩০, সংখ্যালঘু শতকরা ১০ এবং পেশাজীবীদের শতকরা ১০ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাধারণ প্রার্থী কোটায় যে কোনো প্রার্থী থাকতে পারবেন। পেশাজীবী কোটায় থাকবেন শিক্ষক-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-শ্রমিক নেতৃত্ব। এতে সব পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব সংসদে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন দল কোন কোটায় কত আসন লাভ করবে। যে দল সর্বাধিক ভোট পাবে, সে দলই ভগ্নাংশের সুযোগ লাভ করবে। কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করলে ৩টি আসন পাবে। ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেলে ৪টি আসন লাভ করবে। অবশিষ্ট ভগ্নাংশের যোগফলের সুবিধা সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দল ভোগ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করবেন। সে ক্ষেত্রে দলের প্রাপ্ত ভোটাধিক্য প্রথম বিবেচনা হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো দলের প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ, পদত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সংসদ সদস্য পদ হারালে ওই আসনে কোনো উপ-নির্বাচন হবে না। সংশ্লিষ্ট দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে নতুন প্রতিনিধির মনোনয়ন দেবে। নির্বাচন কমিশন তাকেই সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো দলীয় ভিত্তিতে হবে না। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এখানে সরাসরি প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। যে কোনো নির্বাচনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানিপপের ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবর রহমান, এম এ হান্নান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, গোলাম হাবিব দুলাল, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, গোলাম কিবরিয়া টিপু, জাহাঙ্গীর মাহাম্মদ আদেল, মোস্তফা জামাল হায়দার, ফকির আশরাফ, এস এম এম আলম, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু, সাইদুর রহমান টেপা, আহসান হাবিব লিংকন, এ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম, আতিকুর রহমান আতিক, গোলাম মসিহ, মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী, এস এম মান্নান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাইদুল ইসলাম, শুনীল শুভ রায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, হাবিবুর রহমান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বাদল খন্দকার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
এইচ এম এরশাদ বলেন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে দলীয় শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন থাকে না। ১৯৯১ সালের সংসদে বিএনপি মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০ দশমিক ৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন আধিক্যের কারণে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। পরে জামায়াতের সেই সমর্থন সরকারের প্রতি থাকেনি। তখন আওয়ামী লীগ প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলে যায়। এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ ভোটারের রায় পাওয়া সরকার ৭০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখেও তার মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছেড়েছে। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তারা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশের রায় নিয়ে এককভাবে দেশ শাসন করেছে। আবার বিগত নির্বাচনে বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ২৯টি। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই প্রচলিত ব্যবস্থাই যে সর্বোত্তম তা নয়। এটা তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যখন দলীয় শাসন ব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও শুধু দলের ীভত্তিতে হতে পারে। ভোটাররা দলকে ভোট দেবে। সরাসরি প্রার্থীকে নয়। প্রত্যেক দল প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসনের সদস্য পাবে। তবে সদস্য পাবার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের কাস্টিং ভোটের মধ্যে ন্যূনতম ভোট পাবার সীমা থাকবে। প্রত্যেক দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থী প্যানেল তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণার মতো প্রার্থী তালিকা তৈরী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তারপর দেশে বিদ্যমান তিনশ’ আসনেই দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যে দল বেশী ভোট পাবে স্বাভাবিকভাবেই সে দল বেশী সংসদ সদস্য লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্যানেল থেকে ক্রমিক অনুসারে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করবে। যদি কোনো দল কাস্টিং ভোটের ৫০ ভাগ পেয়ে যায় তাহলে তারা ১৫০ আসন পাবে। আবার যদি কোনো দল মোট কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করে তাহলে ৩ এমপি পাবে। ওই দল তাদের প্যানেল থেকে এই ৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে দেবে। প্রাপ্ত ভোটের ভগ্নাংশের সুবিধা পাবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থী প্যানেল তৈরী করে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। যে দল ভালো প্রার্থীর প্যানেল তৈরী করবে জনগণ সেই দলের দিকেই ঝুঁকবে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করতে কোনো সন্ত্রাসী, বিতর্কিত, অরাজনৈতিক বা অযোগ্য বিত্তশালী মুর্খ প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে যাবে না। নির্বাচনী খরচ চালানোর জন্য অর্থশালীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে দলই সমালোচনার মধ্যে পড়বে। একজন সন্ত্রাসীকে প্যানেলে রাখলে গোটা দেশের নির্বাচনে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে। আর কোনো দলের ৩০০ জন প্রার্থীর প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হলেই প্যানেলভুক্ত যে কোনো প্রার্থীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে যে দল যে ক’জন সংসদ সদস্য পাবে প্যানেলের মধ্য থেকে আবার সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীদেরই সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করবে। ভোটাধিক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট করে দেবে কোন এলাকা থেকে কোন দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোনো দলের আসন শুন্য হলে দলের প্যানেল থেকেই দল শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনীত করবে।
বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশ সমূহের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল এবং সর্বশেষ জাপান ও তুরস্কে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রণিত “সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা দেশে দেশে”- গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “বিশ্বের ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ হলো আইন প্রণয়নের জায়গা। এটা দেশ ও জনগণের জন্য কথা বলার জায়গা। আইন সভার সদস্য আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতিনিধি এক নয়। সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। আইন সভার সদস্য সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করতে পারেন। এমনকি তার কাছে জবাবদিহি করারও বিধান রাখা যেতে পারে। আইন সভার সদস্যের রিলিফের চাল-গম বরাদ্দ করার কাজে ব্যাস্ত থাকা সমীচীন নয়। এটা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির হাতে থাকাই উচিৎ। সংসদ সদস্যরা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।
এরশাদ বলেন, প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার ব্যবস্থায় দলের পক্ষে জনগণের রায় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শুধুমাত্র সরাসরি ভোট প্রদান করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। জনগণের হাতে আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। দলীয় সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার-ডেপুটি স্পীকার-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-হুইপ নির্বাচিত হন। এমনকি নির্বাচনে জামানত হারানোর মতো প্রার্থীকেও দল মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে। জনগণ দলের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সুতরাং দল জনগণের রায় পাবার পর সংসদ সদস্য মনোনিত করে দিলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তিনি বলেন, দেশে এখন ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। গোটা জাতির সামনে এখন শুধু অন্ধকারই নয়- বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার একমাত্র কারণ-আগামী নির্বাচন। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়ে দেশের দুটিপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- এই দুটি পক্ষই গত ২২ বছর ধরে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন- মানুষকে শান্তি দিতে পারতেন- কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতেন- তাহলে কোনো কথা ছিলনা। বর্তমানে শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং জাতির সামনে চরম অরাজকতা অপেক্ষা করছে। কী করে এই পরিস্থিতি থেকে আমরা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারি- তার উপায় আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে। আমি এটা প্রস্তাব দিলাম। এখন জনমত গঠন করা উচিত।
সূত্র - দৈ. ইনকিলাব।
0 comments:
Post a Comment