Friday, April 25, 2014

সমবায় সমিতির অবদান, অনিয়ম ও ভবিষ্যৎ

সমবায় সমিতির অবদান, অনিয়ম ও ভবিষ্যৎ
প্রায় ১১০ বছরের প্রাচীন সমবায় সমিতিগুলো অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে এ উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে, দারিদ্র্য বিমোচনে, মন্দা ও দুর্ভিক্ষের প্রাক্কালে জনগণের মধ্যে আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছে। আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলোর অপরিসীম অবদান অনুধাবন করে সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সমবায়কে অর্থনৈতিক মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। 

সরকার সমবায়ের চেতনা ও উপলব্ধিকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯২৯-১৯৩৩ সালের ভয়াবহ বিশ্বমন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সমবায়ের অবদান অসামান্য। ১৯৬০-এর দশকে এ ভূখণ্ডে সমবায়ের কুমিল্লা মডেল দিয়েছে পল্লী উন্নয়নে নতুন যুগের সন্ধান।
অর্থনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সমবায় আন্দোলন বিশ্বব্যাপী অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বজোড়া প্রায় ৮০ কোটি মানুষ সমবায় আন্দোলনের পতাকা তলে সমবেত আছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ৩০০ কোটির বেশি অথবা বিশ্বের অর্ধেক মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রীর হিসাব অনুযায়ী কানাডা, জাপান ও নরওয়েতে প্রতি তিনজনের একজন সমবায়ী। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে প্রতি চারজনের একজন সরাসরি সমবায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গণচীনে ১৮ কোটি, ভারতে ২৩ কোটি ৬০ লাখ, মালয়েশিয়ায় ৫৪ লাখ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯৮ লাখ মানুষ সমবায়ের সদস্য।
এছাড়াও প্রগতিশীল অর্থনীতিতে সমবায় সমিতিগুলো বিপুল অবদান রাখছে। বেলজিয়ামে সমবায়ের মালিকানায় পরিচালিত ওষুধ শিল্প বাজারের ১৯.৫ শতাংশ শেয়ার অধিকার করে আছে। ব্রাজিলে সমবায় সমিতিগুলো কৃষিতে ৪০ শতাংশ এবং কৃষিজাত পণ্য রফতানিতে ৬ শতাংশ অবদান রাখছে। কানাডার সমবায় সমিতিগুলো বিশ্বের ৩৫ শতাংশ ম্যাপেল সুপার উৎপাদন করে। জাপানের প্রায় ৯১ শতাংশ কৃষক সমবায় সমিতির সদস্য। কেনিয়ায় ৪৫ শতাংশ দেশজ উৎপাদন এবং ৩১ শতাংশ জাতীয় সঞ্চয় সমবায় সমিতি থেকে আসে। তেমনিভাবে কোরিয়ার প্রায় ৯০ শতাংশ খামার চাষী কৃষি সমবায়ের সদস্য এবং প্রায় ৭১ শতাংশ মাছের বাজার মৎস্যখাতের সমবায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করে। ডেনমার্ক ও নরওয়ের ৯৫ শতাংশ দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে সমবায়ীরা। বাংলাদেশের মিল্কভিটা বা ভারতের আমুল ও মাদার ডেইরি শ্বেত বিল্পবের সূচনা করেছে।

অতি সম্প্রতি দেশে কয়েকটি সমবায় সমিতিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সমীক্ষাটি চালিয়েছে টিআইবি। তারা সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের উপায় নিয়ে একটি গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছে। তারা মোট ৬ বিভাগের ৮ জেলার ১১টি উপজেলায় ৩৭টি সমিতির তথ্য সংগ্রহ করেছে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৯টি সমিতি নিবন্ধিত আছে। তার মধ্যে মাত্র ৩৭টির ওপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে। টিআইবির মতো একটি প্রতিষ্ঠান এত স্বল্পসংখ্যক সমিতির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ১১০ বছরের প্রাচীন একটি খাতকে অবমূল্যায়ন করেছে, যা সঠিক হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন। এসব সমিতিতে ৯৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৭ জন সদস্য আছে, যারা সমবায়কে অর্থনীতির মূলস্রোত হিসেবে বেছে নিয়েছে। টিআইবি কয়েকটি অতি উত্তম সমিতি যেমন- কিংশুক বহুমুখী সমবায় সমিতি, কার্লব সমবায় সমিতি, বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি, হাজারীবাগ মহিলা সমবায় সমিতি, জনতা বহুমুখী সমবায় সমিতি, কেলাবন বহুমুখী সমবায় সমিতির মতো সফল সমবায় সমিতিগুলোর সঙ্গে আলাপ করেছে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, সমবায় খাত জিডিপিতে ১.৮৬ শতাংশ অবদান রাখে বলে বলা হচ্ছে, যার সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে Economic Internal Rate of Return, Sensitivity Analysis and Cost Effectiveness Analysis সঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

টিআইবি তাদের সমীক্ষায় কয়েকটি সমবায় সমিতির দুর্বলতার কারণ উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কোনো সমিতিকে নিবন্ধনের প্রাক্কালে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না, সমিতিগুলোর আর্থিক লেনদেন সর্ম্পকে ভালোভাবে নিরীক্ষা সম্পাদন করা হয় না, কোনো কোনো সমিতি ৩০-৪৫ শতাংশ সুদ আদায় করে, যা নিয়মনীতিবহির্ভূত, নিরীক্ষার প্রাক্কালে প্রকৃত লভ্যাংশ গোপন করা হয়, অনেক সমিতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় বা রাজনৈতিক মনোনয়ন দিয়ে ওই সব সমিতিকে পক্ষান্তরে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিণত করা হয়, সমিতিগুলোকে কর ফাঁকি দিয়ে কালো টাকার বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয় এবং এর সঙ্গে সমবায়ের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত থাকে। এসব অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সব ক্ষেত্রে এর সত্যতা আছে, এমন কথাও বলা যায় না। তাছাড়া এমন অভিযোগ অনেক সেক্টর সম্পর্কেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
এছাড়া আরও কয়েকটি দুর্বলতা ও অনিয়মের কথা টিআইবি উল্লেখ করেছে এবং বলেছে, ৪৭ শতাংশ সমিতি অকার্যকর আছে। তবে কেন অকার্যকর, তার কিছুটা উল্লেখ করলে সঠিক কারণগুলো জনগণের কাছে পরিষ্কার হতো। সরকার কৃষকদের ৫ হাজার টাকা করে কৃষিঋণ দিয়েছিল। সব কৃষকের এ ঋণ মওকুফ করা হয়েছে, কিন্তু সমবায় সমিতির সদস্য কৃষকদের ঋণ মওকুফ করা হয়নি। এ কারণে অনেক কৃষি সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সুদে-আসলে তাদের অনেক দেনা হয়েছে। অনেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে সমবায় সমিতির কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে বড় কথা হচ্ছে, সমবায় শুধু অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা হল আর্থ-সামাজিক আন্দোলন, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, নবপ্রজন্মকে উজ্জীবিত করার সহায়ক শক্তি। গণমুখী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য-নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টিতে অন্যতম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হচ্ছে সমবায়ী উদ্যোগ।
তাই সমবায়কে দিতে হবে নতুন উদ্দীপনা, সরকারি সব সহযোগিতা, আইন ও বিধিমালা সহজ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ। যেমনটি লক্ষ করা যায় জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড অথবা অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত বিশ্বে। এসব দেশে সমবায় অঙ্গনে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে সমবায় সমিতিগুলো অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এবং বিশ্ববাজারে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
একটি কথা ভুললে চলবে না, পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রিয় মালিকানা উভয়ের যেসব ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সমবায়ের একটি মডেল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিকাশে এবং সমাজে সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার পরিবেশ সৃষ্টিতে সমবায় সমিতিগুলোকে অবদান রাখার সুযোগ দিতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নের ভাবধারা কোনো স্থাপনা নির্মাণে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু জনগণের সম্পৃক্ততা লাভের মাধ্যমে সামাজিক মালিকানার যে গ্রহণযোগ্যতা তা অর্জন করতে সক্ষম হয় না। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমবায় আইনের সহজীকরণ।
সমবায় একটি আন্দোলন। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার একটি বিশাল ক্ষেত্র। প্রতিটি সমবায় সমিতি এক একটি অর্থনৈতিক ইউনিট। প্রতিটি সমবায় সমিতি জনগণকে সংঘবদ্ধ করার একটি বিশাল অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- একা একা ভাত খেলে পেট ভরে, কিন্তু পাঁচজনে বসে একত্রে খেলে পেটও ভরে, আনন্দ হয় এবং পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এ বিষয়টি টিআইবি ভেবেছে কিনা জানি না, তবে তারা সমবায়ের সামাজিক প্রভাবের দিকটিকে আদৌ মূল্যায়ন করেছে বলে মনে হয় না।
সমীক্ষায় কয়েকটি ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে। যেমন সমিতির নিবন্ধনকালে ব্যর্থতা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে ব্যর্থতা, পরিচালনা ও পরিচর্যায় ব্যর্থতা, প্রণোদনায় ব্যর্থতা, উৎসাহ প্রদানে অপারগতা বা অবজ্ঞা এবং নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার কি কোনো অর্থায়ন করেছে এসব সমবায় সমিতিকে? বা বাজেটে সমবায়ের কথা কি কোনোদিন বলা হয়েছে? এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেনি টিআইবি। এমন একটি অর্থনৈতিক খাতকে সরকার অবহেলা করল কেন? সমবায় অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কেন? মোট ২২টি সুপারিশের প্রয়োজন হল কেন? ফরমাল সমবায় সমিতি আর ইনফরমাল সমবায় সমিতির মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এসব কথা কি ভাবা হয়েছে?
কোনো বিদেশী দাতা সংস্থা সমবায়কে অর্থায়ন করে ন্।া অথচ বেসরকারি সংগঠনগুলোকে অবারিত অর্থায়ন করে তাদের ক্ষুদ্রঋণের সক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে সমবায় সমিতিকে প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অনেককে অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে, কারণ সমবায়ের অধিক্ষেত্রে বিদেশী অনুদান হানা দিয়েছে এবং বেদখল করেছে তাদের অধিক্ষেত্র।
দেশের সমবায় সমিতিগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ মহিলা সমবায় সমিতি। এসব সমিতি সব প্রতিকূলতার মাঝে গ্রামীণ জনপদে, কৃষি ও গৃহপালিত পশুদের নিয়ে সমবায় করে, যা অর্থনীতির ভিত্তি বা ম্যাক্রো ইকোনমিক স্থিতিশীলতাকে লালন ও সংরক্ষণ করছে। এসবের কথা ভালোভাবে বলা হয়নি অথবা নারীর ক্ষমতায়নে এসব সমবায় সমিতির অবদানকে আদৌ মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
সমবায় সমিতিগুলোকে অর্থনীতির অঙ্গনে অর্থবহভাবে বিচরণ করার সুযোগ দিতে হবে। আগামীতে এসডিজি আসছে অর্থাৎ টেকসই অর্থনীতির (Sustainable Development Goals) লক্ষ্য অর্জনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনীতিবিষয়ক কমিশন শিগগিরই ১০টি লক্ষ্য অর্জনের কথাও ঘোষণা করবে। এতে অবদান রাখতে হলে সমবায় সমিতিগুলোকে অবশ্যই প্রণোদনা দিতে হবে এবং সরকারকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে জরুরিভাবে।
বলতে দ্বিধা নেই, কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের অথবা সেক্টরের দুর্বলতা তুলে ধরা অনেক সহজ এবং তাতে বাহাবা মেলে। কিন্তু কিভাবে তা টিকিয়ে রাখা যায় বা তার কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তার সুপারিশ দিতে হলে সমস্যার গভীরে প্রবেশের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আশা করি, ভবিষ্যতে সমবায় অথবা এসব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে- এমন কোনো সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করার আগে সংশ্লিষ্টরা বিষগুলি ভেবে দেখবেন। 
লেখক,ধীরজ কুমার নাথ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
সূত্র-দৈনিক যুগান্তর।

0 comments:

Post a Comment