কার্বাইড-ফরমালিন ছাড়া ফল নেই!
ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে বিষাক্ত কেমিক্যাল ছাড়া কোন ফল নেই। খোদ বিক্রেতারাই এমনটি স্বীকার করছেন। পুরান ঢাকার বাদামতলীর ফলের আড়ৎগুলোতে সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশী ফল পাকানোর জন্য মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কার্বাইড। আর বিদেশী ফল সংরক্ষণে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন।
সারি সারি আমের ঝুড়ি। কোনটা সবুজ, কোনটা হলদে রঙের। কিন্তু হাত দিয়ে বোঝার উপায় নেই কোনটা কাঁচা, কোনটা পাকা। বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে টাটকা রাখা হয়েছে এসব ফল। বিক্রয় সংশ্লিষ্ট সবাই এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। খুচরা ব্যবসায়ীরা আসছেন। দরদাম করে নিয়ে যাচ্ছেন। আর সাধারণ মানুষের আস্থা বিক্রেতার ওপরই। তাদের মাধ্যমেই জানছেন কোনটার কি অবস্থা। কোনটা কতদিনে পাকবে বিক্রেতারাই বলে দিচ্ছেন। টাকা দিয়ে তারা যে কেমিক্যাল মেশানো ফল কিনছেন ব্যবসায়ীরা স্বীকার না করলেও বুঝতে বাকি নেই সাধারন ক্রেতাদের। এটা জানার পরও যেন কিছুই করার নেই তাদের। ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে বিষাক্ত কেমিক্যাল ছাড়া কোন ফল নেই। খোদ বিক্রেতারাই এমনটি স্বীকার করছেন। পুরান ঢাকার বাদামতলীর ফলের আড়ৎগুলোতে সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশী ফল পাকানোর জন্য মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কার্বাইড। আর বিদেশী ফল সংরক্ষণে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। তবে পাইকারি ও খুচরা বেশির ভাগ বিক্রেতাই এসব ক্ষতিকারক পদার্থ মেশানোর কথা অস্বীকার করেন। তাদের দাবি মালগুলো বাজারে ঢোকার আগেই বাদামতলী ঘাটে চেকপোস্ট বসিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাড়া হয়। তাদের এ দাবির সত্যতা জানতে সরজমিনে সেখানে গিয়ে কোন চেকপোস্ট চোখে পড়েনি। একের পর এক মালভর্তি ট্রাক আসছে কোন বাধা ছাড়াই। একজন সাধারণ ক্রেতা জানালেন, তারা জানেন এসব ফলে বিষাক্ত পদার্থ মেশানো হয়। এসব কথা চিন্তা করলে তাদের কখনওই ফল খাওয়া হবে না। কারণ রাজধানীর এমন কোন বাজার নেই যেখানে টাটকা ফল পাওয়া যাবে। তাই সব কিছু জানার পর যেখানে দামে কম পাওয়া যাবে সেখান থেকেই তারা ফল কিনবেন। আড়তের ইমতিয়াজ ফল ভাণ্ডারের বিক্রেতা মিন্টু ব্যাপারী জানান, এখানে কোন ফলেই ফরমালিন মেশানো হয় না। তবে একটু পরেই তিনি বলেন, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড মেশানো হয়। ক্রয়কৃত অপরিপক্ব ওই সব ফলে কার্বাইড না মেশালে পাকার আগেই পচন ধরে। তবে এ কাজ তারা নিজেরা করেন না বলেও দাবি করেন। আরেক পাইকারি বিক্রেতা আল- মদিনা ট্রেডার্সের মাসুদ জানান, আমরা এখান থেকে কিছুই মেশাই না। যেখান থেকে আমগুলো আসে সেখানেই মেশানো হয়। কোথা থেকে এ আমগুলো আসে জানতে চাইলে বলেন, এগুলো সাতক্ষীরা থেকে এসেছে। গাছ থেকে আমগুলো পাড়ার পরপরই তারা কেমিক্যাল মেশায়। এক্ষেত্রে তাদের কোন হাত নেই বলেও দাবি করেন। সেখানকার একজন বিক্রেতার মোবাইল নম্বর চাইলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। আমরা ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করেই মাল কিনি। আল-মদিনা মার্কেটের সামনে এক বিক্রেতার সঙ্গে ক্রেতা সেজে কথা বললে মেলে দুই ধরনের তথ্য। সংরক্ষণের জন্য কিনবো বললে তিনি সবুজ রঙের আমগুলো দেখান। বলেন, এগুলো দীর্ঘদিন রাখতে পারবেন। এগুলো ফরমালিন দেয়া অভিযোগ করে পরিবারের খাওয়ার জন্য ফরমালিনমুক্ত আম কিনবো বললে তিনি আরেকটি ঝুড়ি দেখান। তিনি বলেন, পরিবারের জন্য এ ঝুড়ি থেকে নেন। এখানে কোন কেমিক্যাল দেয়া নেই। এদিকে কলার আড়তে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই এক ব্যবসায়ী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ফরমালিন ছাড়া কোন মাল আছে নাকি? এ সময় অন্য এক ব্যবসায়ী শান্ত গলায় বলেন, ভাই কেমিক্যাল না দিলে আপনারাই তো খেতে পারবেন না। তার আগেই নষ্ট হয়ে যাবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টের ভয়ে রাতের আঁধারে এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর কাজ হচ্ছে। আর কেমিক্যাল মেশানোর কথা অকপটে স্বীকার করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই দেশী ফলে কার্বাইড মিশিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকানো হয়। এতে ফলগুলো লালচে বা হলুদাভ রঙ ধারণ করে। কেমিক্যাল না মেশালে ক্রেতারা আকৃষ্ট হন না। বেশি মাত্রায় ফরমালিন মেশানো হচ্ছে আপেল, আঙুর, কমলা ও মাল্টায়। মুখরোচক এ ফলগুলো বেশি দিন সংরক্ষণ করতে হয় বলে ফরামলিনের মাত্রাও থাকে বেশি। বাবুবাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানান, শুধু বিদেশী ফল নয়, লিুচতেও আজকাল ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। তবে মওসুমের শুরুতে লিচুর আমদানি কম থাকায় এখনও ফরমালিনের ব্যবহার শুরু হয়নি বলে জানান তিনি। চাঁপাই নবাবগঞ্জের একজন আম ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই মূলত কার্বাইড মেশানোর কাজটি করা হয়ে থাকে। আর মহাসড়কে ফলের গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। রাস্তায় আটকে থাকার কারণে ফল দ্রুত পেকে যায় এবং অনেক সময় পচন ধরে। পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়েই কেমিক্যাল মেশাতে হয়। অনেক সময় খুচরা বিক্রেতারা জানে না কতদিনে বিক্রি করতে পারবেন। আবার পাইকারি বিক্রেতারাও অনেক ক্ষেত্রে বিক্রির টার্গেট পূরণ করতে না পারায় সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ফরমালিন মেশাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মধ্যে রাজধানীর সকল বাজার মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। কারণ একটি বাজারে অভিযান চালাতে কয়েকটি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। ডিএমপি’র সঙ্গে বিএসটিআই’র কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ দলকে সঙ্গে রাখতে হয়। এই সমন্বয়ের কাজটি করতে গিয়ে সময়ের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় বাজারগুলোতে পৌঁছানোর আগেই বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়। তিনি জানান, ঢাকার বাইরে থেকে যেসব দেশী-বিদেশী ফল আসছে সেগুলোর মান পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্টগুলো তৎপর হলে কেমিক্যাল মেশানোর কাজটি কমিয়ে আনা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. সাকলায়েন রাসেল ফলে কেমিক্যাল মেশানোর ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, কার্বাইড, ফরমালিনসহ যে কোন কেমিক্যাল ক্ষতিকর। কেমিক্যালযুক্ত ফল খাওয়ার কারণে দেহের এমন কোন অঙ্গ নেই যেটা ক্ষতিহগ্রস্ত হয় না। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার ও কিডনি। মানুষ জটিল সব রোগে আক্রান্ত হয়। এ সব কেমিক্যালযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে এখন যুবক বয়সেই মানুষ কিডনি ও লিভারের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক সময় ক্যান্সারও হয়। বর্তমানে কিডনি বিকল হয়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে বলেও জানান তিনি। এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের বিদেশী ফল খাওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। যেসব দেশী ফলে কেমিক্যাল মেশানোর সুযোগ নেই বা প্রয়োজন পড়ে না মানুষকে সেসব ফল খেতে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন- পেয়ারা, আমড়া, আমলকী, সফেদা। এসব ফল পুষ্টিগুণের দিক থেকে যে কোন ফলের চেয়ে সমৃদ্ধ।সূত্র - দৈনিক মানবজমিন
0 comments:
Post a Comment