Saturday, June 7, 2014

খাবার মানেই বিষের ভয়


খাবার মানেই বিষের ভয়

খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ভেজাল নিয়ে দেশজুড়ে ঘরে-বাইরে, জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আতঙ্কের শেষ নেই অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে- বেঁচে থাকার জন্য প্রধান মৌলিক চাহিদা যে খাদ্য- সেই খাদ্য সামনে নিয়ে বসলে প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে- ভেজাল নেই তো! বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো না তো! কিন্তু কিছু করার নেই। এ রকম ভয়ের মধ্যেই চলছে আমাদের খাওয়া-দাওয়া। পরিণতিতে শরীরে বাসা বাঁধছে জটিল রোগ-বালাই; ঘটছে মৃত্যু পর্যন্ত।



বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল বা বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রবেশ ঘটে। সামান্য কিছুটা প্রাকৃতিকভাবে হলেও বেশির ভাগই হয়ে থাকে অসচেতন কৃষক আর স্বার্থান্বেষী, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এর মধ্যে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক কৃষিতে ব্যবহারের ফলে পানি, মাটি বা গাছ হয়ে খাদ্যশস্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে; আবার কিছু রাসায়নিক একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরাসরি বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, মাছ-মাংস-দুধ, মসলাসহ নানা খাদ্যে ভেজাল, আকর্ষণী বা মুনাফাবর্ধক উপাদান হিসেবে প্রয়োগ করে থাকে।
খাবার মানেই বিষের ভয়
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সম্প্রতি দেশি-বিদেশি একদল গবেষক ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান এলাকাসহ আরো বেশ কিছু বড় বড় বাজার থেকে এসব খাদ্যের নমুনা (স্যাম্পল) সংগ্রহ করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়।
ওই গবেষণার ফলাফল অনুসারে ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এ ছাড়া আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। এ ছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসের নমুনায় পাওয়া গেছে বেঞ্জয়িক এসিড, যা স্বাস্ব্যহানিকর।
'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' প্রকল্পের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সারা দেশের পরিস্থিতি এখনো আমরা দেখতে পারিনি। তবে ঢাকায় আমরা গবেষণার মাধ্যমে যে ভয়াবহ চিত্র পেয়েছি তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছি। এখন এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার দায়িত্ব সরকারের।'
গবেষক দলের সূত্র জানায়, যখন এ গবেষণা হয়, তখন বাজারে দেশীয় মৌসুমি ফল ছিল না। তাই ওই সময় প্রাপ্ত ফলের মধ্যে আপেল ও আঙ্গুরে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে। তবে তখনো বাজারে থাকা কিছু আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল। ব্রয়লার মুরগি ও চাষ করা মাছের মধ্যে রুই-কাতল জাতীয় মাছে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ফরমালিন ছিল বিভিন্ন মাছে। শুঁটকিতেও মিলেছে বিষাক্ত রাসায়নিক। এ ছাড়া হলুদ ও লবনে সীসাসহ আরো কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো চকচকে ও ভারী করা হয়।
প্রবীণ চিকিৎসক ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এখন কিছুই যেন নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে খেতে পারছি না। বাজার থেকে কিছু কিনতে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হয়, দ্রব্যটি নিরাপদ না বিষযুক্ত- সেই চিন্তায়। এমনটা তো চলতে পারে না! তাই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন রক্ষায় দেশে এখন এক নম্বর ইস্যু হওয়া দরকার নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি। খাদ্যই যদি নিরাপদ না হয়ে বিষযুক্ত হয়, তবে মানুষ বাঁচবে কী করে?'
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে সর্বজনীন উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক থাকলেও পরিস্থিতি রোধে সমষ্টিগত কোনো উদ্যোগ নেই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা ইস্যুতে আন্দোলন হলেও সবচেয়ে বড় এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনও এগিয়ে আসছে না। ফলে রাষ্ট্রের আইন ও আদালতের নির্দেশনাও আশানুরূপ সুফল বয়ে আনছে না। রাষ্ট্র বা সরকারের একার পক্ষে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। দরকার দলমত নির্বিশেষে এই ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এ বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্র বা সরকার আইন করলেও মানুষ অনেক সময়ই তা মানে না। এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারকে দুষলেই হবে না, মানুষের সচেতনতা খুবই জরুরি। পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা-ও দেখতে হবে।
রফিক-উল হক উদারহণ দিয়ে বলেন, 'খুন করলে ফাঁসি হতে পারে, সবাই জানে। তার পরও তো সমাজে খুন বন্ধ হচ্ছে না। আমরা তো দেখছি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে, অনেক ফল-সবজি-মাছ নষ্ট করা হচ্ছে, তার পরও তো একই অবস্থা আবার চলে।'
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ফল-ফসলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ানোর দায় কৃষি বিভাগের। কারণ কৃষিতে কী ধরনের কীটনাশক-বালাইনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে তা দেখভালের দায়িত্ব তাদের। এ ক্ষেত্রে তাদের আইন আছে, কর্তৃপক্ষ আছে। যদি ওই আইনের আওতায় নিয়মমাফিক কীটনাশক-বালাইনাশক কিংবা সার প্রয়োগ করা না হয়, যদি এসবের যথেচ্ছ ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাহলে এ বিষয়ে তাদের দিক থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এদিকে কেবল 'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' প্রকল্পের মাধ্যমেই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এর আগে ২০১২ সালে পাঁচ হাজার ৩১২টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে দুই হাজার ৫৫৮টিতেই বা ৪৯ শতাংশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বা ভেজালকারী উপাদান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গবেষণায়ও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন খাদে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত এবং মাত্র ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। আর কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মেশে। এ ছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরো কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়। এতে একদিকে যেমন সরাসরি মাছ ও মাছের ডিমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, অন্যদিকে পানিতে থাকা মাছের খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা) ও জুপ্লাংকটন (প্রাণিকণা) তাৎক্ষণিক মরে যায়। ফলে জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছের খাদ্য নষ্ট হয়, পানি নষ্ট হয়। আবার মাছ থেকে তা মানবদেহে চলে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, কার্বামেট, আর্সেনিক, সীসা- সবই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে খাদ্যজাত কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এখন দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্তত কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল এবারকার গবেষণায়ই নয়, এর আগেও আইইডিসিআরসহ বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশে বিভিন্ন খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তিনি জানান, খাদ্যে যেসব রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তাতে পাকস্থলী, কিডনি ও লিভারের রোগ এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার 'ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ' কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সবাই চায় নিরাপদ খাদ্য। কিন্তু এটা নিয়ে এত দিন তেমন কোনো কাজ ছিল না। এ ক্ষেত্রে যেসব সিস্টেম বিদ্যমান, তাও দুর্বল। রাজনৈতিক বা সামাজিক অঙ্গীকারও তেমন ছিল না। তবে বর্তমান সরকারের দিক থেকে নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট আছে বলেই নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ করা হয়েছে। এখন এই আইনের আওতায় বিধিমালা প্রণয়ন ও কর্র্তৃপক্ষ তৈরির মাধ্যমে আইন প্রয়োগ শুরু হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করি।'

ওই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল আইনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। এমন ইস্যুতে জনসচেতনতাও বড় ফ্যাক্টর। তাই সামাজিকভাবে খাদ্যে ভেজাল ও বিষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

সুত্র দৈনিক কালের কন্ঠ

0 comments:

Post a Comment