হাসান সোহেল ও সায়ীদ আবদুল মালিক : বিষ মেশানো ফলে সয়লাব বাজার। ক্রেতারা ভয়ে মৌসুমী এসব ফল কিনতে সাহস পাচ্ছে না। আবার অনেকেই বাজার থেকে কেনা এসব ফল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। রয়েছে মৃত্যু ঝুঁকিও। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গি, আনারসসহ বিভিন্ন ফলে মেশানো হচ্ছে মরণঘাতী এই কেমিক্যলি। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত ফরমালিন মেশানো ফলের বাজারে অভিযান চালালেও তা একেবারেই লোক দেখানো। এদের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে না কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
এদিকে, নজরকাড়া রঙে বাজারে রয়েছে হরেকরকম ফল। এসব ফলের রং টকটকে লাল কিংবা গাঢ় হলুদ। মৌ মৌ গন্ধ। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে বেশি দাম দিয়েও এসব ফল ক্রয় করছেন। বাহারি রংয়ের এই ফল গাছ পাকা নয়। এ ফলে মাছি কিংবা মৌমাছি কোনটাই বসতে দেখা যায় না। চোখে পড়ে না, দেখা মেলে না পিঁপড়ারও। এর কারণ এসব ফল কার্বাইড ও ফরমালিন মিশ্রিত। কেমিক্যাল নামে বিষ মিশিয়ে এই ফল বিক্রি হচ্ছে সারা দেশের শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শুধুমাত্র ফলের পচন এড়াতে মেশানো হচ্ছে মানবদেহে ক্যান্সারবাহী এই বিষাক্ত কেমিক্যাল। আর বিষ মেশানো এসব ফল খাচ্ছে দেশের কয়েক কোটি মানুষ। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সামনেই চলছে এই বিষ মেশানোর কাজ। কিন্তু কারোরই নেই সেদিকে নজর। সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে এইসব ফল খাওয়া এবং ক্রয় নিয়ে ভীতি বিরাজ করছে। অনেক ক্রেতা ভালো-মন্দ বিচার না করতে পেরে ক্রয় করছেন এসব মৌসুমী ফল। খেয়ে ভুগছেন বিভিন্ন অসুখে। রাজধানীর প্রতিটি বাজারে বিক্রি হচ্ছে এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল। এমনকি ফরমালিন মুক্ত সাইনবোর্ড টানিয়ে মৌসুমী ফল বিক্রি হচ্ছে তাও কতটুকু ফরমালিনমুক্ত এ নিয়েও প্রশ্ন জনমনে। কারণ এ ধরনের মুক্ত বাজারেও মিলছে বিষাক্ত এ বিষ মিশ্রিত ফলের সমারোহ। তাই এ ধরনের বাজারগুলোতে শোভা পাওয়া ফলগুলো ভেজালুমক্ত কি না সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই’র। এছাড়া যারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তারাও এই বিষ খাচ্ছেন। তারপরও নেয়া হচ্ছে না কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের দু’একটা অভিযান দেখা গেলেও তা শুধুমাত্র লোক দেখানো।
এদিকে সামনে রমাজন মাস। রমজানে এসব ফলের কদর বেশি। এই মাসেই মুসলমানরা প্রতিদিন ইফতারির সময়ে রকমারি ফল দিয়ে তাদের রমজানের ক্লান্তি দূর করেন। কিন্তু এসব ফলে ফরমালিনের অধিক্য থাকায় উদ্বিগ্ন দেশের মুসলমানরা। সরকার ২ বছর আগে ফরমালিন আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ফরমালিন নামের বিষের ভয়াবহতা কমেনি। এর আগেও হাইকোর্ট থেকে এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা থাকলেও কোনো কাজ হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসটিআই-এর একটি সূত্র জানিয়েছে, জনবল সঙ্কটের কারণে তাদের অভিযান চালানোয় সমস্যা হচ্ছে। জনবল কিছুটা বাড়ানো হলেও এখনো পর্যাপ্ত নয়। তাই কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এ ধরনের অভিযান চালানো সহজ নয়। যদিও গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি জানান, আগামী বুধবার থেকে রাজধানীর আটটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চালাবে পুলিশ। মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেই ঘটনাস্থলে ফল ধ্বংস করা হবে। অপরদিকে গতকাল সংসদে ফরমালিনের ব্যবহার ঠেকাতে এ বিষয়ক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ফরমালিন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সেসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আইন সংশোধন করে কঠোর সাজার সংশোধনী প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংসদের চলতি অধিবেশনেই সংশোধিত আইনটি পাস হবে। এছাড়া সম্প্রতি এফবিসিসিআই’র এক আলোচনা সভায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় যাবে। এরপর আইনটি সংসদে যাবে। সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশনে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন পাসের উদ্যোগ নেয়া হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক এই পদার্থ (বিষ) ব্যবহারে ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, কিডনির রোগ, লিভার সিরোসিস এবং নানা মরণব্যাধিতে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। একই সঙ্গে ভেজাল এই ফলমূল খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মেয়েদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে, প্রতিবন্ধী শিশুরও জন্ম হতে পারে। এ থেকে প্রতিকার পেতে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। বাজারে ফলমূল দেখে-শুনে কিনতে হবে।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন ফলের বাজার ঘুরে দেখা যায়, অভিজাত সুপার শপ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের ফলের দোকান কিংবা নিম্নবিত্তের ফুটপাত বাজার সবখানেই এই বিষাক্ত ফলের সমারোহ। কেমিক্যালে পাকানো কলা অথবা হিট দেয়া বেলের সাথে আছে বিষাক্ত পেয়ারাসহ হরেক ফল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাগান থেকে অপরিপক্ব ফল পেড়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তা ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। বর্তমানে বাজারে রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ও লিচু বলে যা বিক্রি হচ্ছে তার সবই কার্বাইডে পাকানো বলে স্বীকার করেছেন ওই অঞ্চলের একাধিক ফলের আড়তদাররা।
রাজশাহীর শাল বাগান এলাকার পাইকারি ফল ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ জানান, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগানগুলোতে এখনো আম পাকতে শুরু করেনি। স্বাভাবিকভাবে আম পাকতে আরো অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, ঢাকার অসৎ ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে গাছ থেকে চাষিদের দিয়ে অপরিপক্ব আম পেড়ে কার্বাইড দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছেন। যা ঢাকা পৌঁছেতে গিয়ে পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। ফরিদ আহমেদ আরো জানান, এখানকার গাছ পাকা আম কখনো এতোটা হলুদ হয় না, যতটা ঢাকার দোকানে শোভা পায়। লিচু সম্পর্কে তিনি বলেন, খরায় এবার লিচুর ফলন কম। অতিরিক্ত তাপে লিচু পাকার আগেই গাছে ফেটে নষ্ট হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে স্থানীয় জাতের গুটি লিচু উঠলেও তা এখন শেষ পর্যায়ে। ৪/৫ দিন হলো বোম্বাই জাতের লিচু বাজারে আসলেও তার পরিমাণ কম। বেশির ভাগ লিচুই ফরমালিন ও বিষ দিয়ে বাগান থেকে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটগুলোতে ভেজাল আম মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারে আসে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায় জুন মাসের ১ তারিখ থেকে। কিন্তু অভিযানের মধ্যেও দেখা যায় ফরমালিনমুক্ত ফলের মার্কেটেও ফরমালিনযুক্ত ফল। অভিযানের কারণে তাৎক্ষণিক কিছুটা ফরমালিনের আধিক্য কমলেও অভিযানের পরপরই আবার মার্কেগুলোতে বিক্রি হচ্ছে কেমিকেলযুক্ত বিষাক্ত বিভিন্ন ফল। এছাড়া অভিযান চলাকালীন কয়েকদিন এসব বাজারে বিক্রি বন্ধ থাকলেও কিছু দিন পর আবার বিক্রি চলে পুরোদমে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কার্বাইড মেশানো আম দেখতে অনেকটাই চাকচিক্য এবং ন্যাচারাল কালার হবে। এর গায়ের রং হবে চকচকে। দেখে বোঝার উপায় নেই এ আমে কেমিক্যাল মেশানো হয়েছে। বিষাক্ত কার্বাইড মেশানো আম নাকের কাছে ধরলে আসল গন্ধ পাওয়া যাবে না। খেয়েও পাওয়া যাবে না এর আসল স্বাদ। তাদের মতে, বিষাক্ত এসব আম চেনার অন্যতম উপায় হলো ২/৩ দিনের মধ্যে এ আমের চামড়া শুকিয়ে যাবে। কার্বাইডমুক্ত আম শুকালে সুঘ্রাণ পাওয়া যাবে। এ আমের খোসা অপেক্ষাকৃত সবুজ হবে। রাজশাহীর হিমসাগর, ল্যাংড়া বা ফজলি আমের খোসা সবুজ না হলে বুঝতে হবে, তাতে কার্বাইড মেশানো হয়েছে।
পল্টন বায়তুল মোকাররমের উল্টো পাশের ব্যবসায়ী আকমল হোসেন জানান, ফলে ফরমালিন আছে কি না বলতে পারবো না। আমরা আড়ত থেকে আনি, তারা ভালো বলতে পারবেন। ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন জানান, আম প্রথমে রাজশাহী আসে। রাজশাহী থেকে ধাপে ধাপে বিক্রি পর্যন্ত সপ্তাহ চলে যায়, মাঝখানের এই সময় আম টিকিয়ে রাখতে অনেক সময় মেডিসিন দেয়া হতে পারে।
পলাশী বাজারে একটি ফলের দোকান থেকে আম কিনছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান। ফরমালিনমুক্ত আম কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, এই আম কেনা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, মৌসুমী ফল বাজারে এসেছে তাই কিনতে হচ্ছে। পরিবারের সবাই আম খেতে চাইছে তাই কিনেছি। এখন এসব ফলে ভেজাল আছে কী না তা বের করা সরকারের দায়িত্ব। কেমিক্যাল দিয়ে নাকি কেমিক্যাল ছাড়া আম পাকানো হয়েছে, তা তো আর আমরা বুঝতে পারি না। বিক্রেতাদের কথা বিশ্বাস করে আম কিনতে হচ্ছে।
মালিবাগে ফল কিনতে আসা গৃহিণী তানিয়া আক্তার বলেন, ফলে ফরমালিন থাকবে এ আর নতুন কি? জেনে শুনেই বাৎসরিক এ মৌসুমী ফলের নামে বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ভালো ফল পাবার নির্ভরতা কোথায়? তিনি অভিযোগ করে বলেন, কোনো আইন বা উদ্যোগ ফরমালিন বন্ধ করতে পারছে না। সাজানো গোছানো মৌসুমী ফলের নামে বিষ বিক্রি হচ্ছে। আমরা বাধ্য হয়ে এ ফল কিনছি, তাও আবার চড়া দামে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যেন কিছুই করার নেই। আর আইন হলেও তাতো আর দেশে বাস্তবায়ন হয় না।
ধানমন্ডি ক্লাব, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠ, মালিবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ি, শনিরআখরা, ফার্মগেটসহ নগরীর বিভিন্ন জায়গায় চলছে এখন কার্বাইডমুক্ত আমের মেলা। আয়োজক ও বিক্রেতারা অবশ্য এ মেলায় জোর গলায় বলছে, তাদের এখানে বিক্রি হওয়া আম শতভাগ কার্বাইডমুক্ত আর বাইরে বিক্রি হওয়া আম কার্বাইডযুক্ত। অবশ্য বাইরের বিভিন্ন দোকানিরা এটা মানতে নারাজ। তারা জানান, মেলায় কিছু কিছু আমে কার্বাইড দেয়া হয়। যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজার আমের আড়তে গিয়ে পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় আসা বেশির ভাগ আমেই কার্বাইড মেশানো হয়। তবে কার্বাইড গাছ থেকে পেড়েই স্প্রে করে দেয়া হয়। এতে ঢাকায় আসতে আসতে আম পেকে যায়। আবার কাঁচা আম ঢাকায় এনেও ক্ষতিকর কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। দু-একজন ব্যবসায়ী অস্বীকার করলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমে কার্বাইড মেশানোর স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। এমনকি গতকালও রাজধানীর কলাবাগান এবং ধানমন্ডি মাঠের পাশে ফরমালিনমুক্ত ফলের দোকান থেকে আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফরমালিনযুক্ত ফল ধ্বংস করা হয়েছে।
এদিকে মৌসুমী ফলের অন্যতম আকর্ষণ লিচু বাজারে এসেছে পুরোদমে। দেশের সর্বত্র এখন পাকা লিচুতে ভরপুর। বাজারের আসা লিচুর ওপরের রং এবং দেখতে তাজা হলেও ভেতরে পরিপক্বতার কারণে তার স্বাদ ও গন্ধ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবেই দেশের মানুষ বাজার থেকে ফল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অহরহ। আর এসব পাকা লোভনীয় লিচু ক্রেতা কিনে নিয়ে তার সাথে যে বিষও কিনে নিয়ে যাচ্ছে তাও তারা বুঝতে পারছে না।
বাজারের এসব লোভনীয় লিচু গাছে পাকার আগেই যাতে বাড়তি রঙে রঙিন হয়ে ওঠে সে কারণে গাছে বিষাক্ত রাসায়নিক কার্বাইড দিয়ে স্প্রে করা হয় আর যা মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মেলায় কিংবা বাজারের আমগুলোয় ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হবে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, বাজার ও আমের আড়তে গত ৮দিন ধরে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি।
সম্প্রতি অবাধে ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মেশানো ও বিক্রি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন মেশানো, অপব্যবহার, অবাধে বিক্রি বন্ধ করতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ফরমালিন আমদানি নিষিদ্ধসহ এর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে এফবিসিসিআই।
জানা যায়, সরকার প্রায় দুই বছর পূর্বে ফরমালিন আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ফরমালিন নামের বিষের ভয়াবহতা কমেনি। এর আগেও হাইকোর্ট থেকে এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা থাকলেও কোনো কাজ হয়নি। এদিকে গত বছরের ১ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের সভায় ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ এর খসড়ায় খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সাত বছর কারাদ-ের বিধান রেখে আইন করার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজার মেয়াদ বেড়ে দ্বিগুণ হবে, অর্থাৎ ১৪ বছর। যদিও এই আইনের বাস্তবায়ন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ইথোফেনের মতো বিষাক্ত জিনিসের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে ফলকে আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কেমিক্যাল জাতীয় রং। আর পচনরোধে স্প্রে করা হয় ফরমালিন। ফলে এখন আর কোনো ফল পচে না। মাসের পর মাস আঙ্গুর থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে দোকানে। নির্ধারিত লাভ ছাড়া বিক্রি না হলে ক্ষতি নেই। আম, কলা, নাসপাতি, আপেল, কমলা এমনকি কাঁচাবাজারের টমেটোও শক্ত হয়ে থাকে দিনের পর দিন।
একটি বেসরকারি পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পরিবেশ বাঁচাও’ আন্দোলনের সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব ভীতিকর তথ্য। তাদের মতে, নগরীতে বিক্রি হওয়া আমের শতকরা ৯৪ ভাগই ফরমালিনযুক্ত। শুধু আম কেন? জাম ও লিচুতেও ফরমালিনের উপস্থিতি শতভাগ। এছাড়া মালটা, আপেল, আঙুর, কমলা, টমেটো, তরল দুধ ও মাছেও ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, ফরমালিনের কারণে লিভারে হেপাটাইটিস ও লিভার পচন বা সিরোসিস হতে পারে। এ ছাড়া অ্যালার্জিক সমস্যা হতে পারে। কার্বাইড মেশানো ফল খেলে বাচ্চা ও গর্ভবতী মায়েদের বেশি ক্ষতি হয়।
এক সময়ে ভেজালবিরোধী অভিযানে সাড়া জাগানো ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলা সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, জনসচেতনতা মূলত সৃষ্টি করেছে দেশের গণমাধ্যম। মিডিয়ার কারণেই মানুষ সচেতন হয়েছে। এর পেছনে মিডিয়ার অবদানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। তাহলে মানুষ আরো সচেতন হবে। পাশাপাশি জনগণকে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে সহযোগিতা করতে হবে। ভেজালবিরোধী অভিযান ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশ, জনগণ ও জাতির স্বার্থে ভেজালবিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
বিএসটিআই’র মহাপরিচালক ইকরামুল হক বলেন, বাজারে বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত মৌসুমী ফল যেন না ঢুকতে পারে সে জন্য আমরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের ১২ জন অফিসার প্রতিদিন নিরলসভাবে এ কাজটি করে যাচ্ছে। মোসুমী ফলের মৌসুমে তাদের অন্য কাজ থেকে এনে এ কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু মাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল, জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিল করলেই এ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা যাবে না। তাই জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। তাহলে এ নীতিগর্হিত কাজটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবুল হোসেন মিঞা বলেন, ফরমালিন যুক্ত ফল প্রতিরোধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। মহানগরসহ বিভাগ, জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় বাজার মনিটরিং কার্যক্রমও অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে প্রচারমূলক কাজও অব্যাহত রয়েছে।
ক্যাব সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, এ দেশে আদালতের যে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা, তা এড়াতেই ভোক্তারা মামলার ঝামেলায় যেতে চায় না। বর্তমানে মোবাইল কোর্ট আইনের প্রয়োগের কারণে কিছুটা অগ্রগতি ঘটলেও জনসচেতনতা তৈরিতে আরো সময় লাগবে। একই সঙ্গে আমলাতন্ত্রের একটি অংশ ফরমালিন ব্যবহারের পক্ষে ভূমিকা রাখছেন বলেও উল্লেখ করেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, বাজারে আসা মৌসুমী ফলে ভেজাল ধরতে মাঠে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হয়েছে। রাজধানীর নানা স্থানে অভিযান চালিয়ে কেমিক্যাল মেশানোর দায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রচুর আমসহ নানা মৌসুমী ফল ধ্বংস ও জেল-জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান এ মাস চলবে। নিয়মিত অভিযান ছাড়াও যখনই খবর পাই তখনই আমরা মাঠে নামবো। একই সঙ্গে আসন্ন রমজান মাসকে নিয়ে বিএসটিআই’র বিশেষ অভিযান চলবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।