Saturday, January 18, 2014

শুঁটকিতে বিষ - মানুষ শখ করে খাবে কি ?

শুঁটকিতে বিষ!


শুঁটকি মাছ! জিভে পানি আসার মতো খাবার। এই খাবারটি খেতে পছন্দ করে না এমন লোক খোঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু সাবধান! সুস্বাদু এই খাবারে মেশানো হয় কীটনাশক, বিষাক্ত রাসায়নিক। যা মানবদেহে প্রবেশ করে দেখা দিতে পারে জটিল সব রোগ। ত্বরান্বিত হতে পারে মৃত্যু। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা, পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা ও দীর্ঘদিন তা সংরক্ষণের জন্য শুঁটকিতে মেশানো হয় এনড্রিন, বাসুডিন, এগস, ডাইমেক্রন, হেপাটেকলোর, ডিডিটি পাউডার, গ্যার্মোক্সিন পাউডার সহ মারাত্মক সব বিষাক্ত কীটনাশক। শুধু তাই নয়, শুঁটকি যাতে পচে নষ্ট না হয় সে জন্য মেশানো হয় ফরমালিনসহ বিষাক্ত রাসায়নিক। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের খাদ্য ও বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির নিউটিশান অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কে এম ফরমুজুল হকের তত্ত্বাবধানে সমপ্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছকে শুঁটকিতে পরিণত করে তা দীর্ঘ দিন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয়। মাছি পোকা যাতে শুঁটকির ভেতর প্রবেশ করতে না পারে এজন্য শুঁটকিতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে গবেষক ড. ফরমুজুল হক মানবজমিনকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি জমি পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যে সব কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় ঠিক একই কায়দায় শুঁটকি মাছ সংরক্ষণ করতেও তা ব্যবহার হচ্ছে। এই কীটনাশকের কার্যকারিতা কখনও নষ্ট হয় না। খাওয়ার সঙ্গে তা শরীরে প্রবেশ করে ‘নীরব গণহত্যা’ চালাচ্ছে। তিনি বলেন, যারা এগুলো করছে তারা হয়তো না বুঝে সচেতনতার অভাবে করছে। তাই প্রয়োজন গণসচেতনতা তৈরি করা। বিষয়টি ভয়াবহ আকারে রূপ নেয়ার আগেই মৎস্য আহরণ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে সবাইকে বোঝানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমি নিজেও এ বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি সবার আগে প্রয়োজন দেশে মৎস্য আহরণ ও তা সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে আধুনিকীকরণ করা। ড. ফরমুজুল বলেন, মালয়েশিয়ার মানুষ আমাদের চেয়ে বেশি পরিমাণ শুঁটকি সংরক্ষণ করে। তাদের খাদ্য তালিকায় শুঁটকির পরিমাণও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তাদের শুঁটকিতে উৎকট গন্ধ থাকে না। যেটি আমাদের দেশের শুঁটকিতে থাকে। মালয়েশিয়ায় মৎস্য আহরণ, শুঁটকিতে রূপান্তর ও তা সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বেশ আধুনিক। খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, শুঁটকিতে মেশানো কীটনাশকজাতীয় বিষের কার্যকারিতা থাকে দীর্ঘ দিন। এমনকি রান্নার পরও এর কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। ফলে শরীরে তা প্রভাব পড়ে। দেখা দেয় বিভিন্ন জটিল রোগ। তারা বলছেন, এসব কীটনাশক ও রাসায়নিক মেশানো শুঁটকি মাছ খেয়ে মানবদেহে যে সব রোগ বা রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে তার মধ্যে রক্ত শূন্যতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, চোখ ও ত্বকে জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট, জন্ম বিকলাঙ্গতা, নিদ্রাহীনতা সহ ক্যান্সার, জন্ডিস, হার্ট অ্যাটাক, লিভার ড্যামেজ ও মরণব্যাধি ক্যান্সারের মত মারাত্মক সব রোগ। মৎস্য অধিদপ্তর ও রাজধানীর সবচেয়ে বড় শুঁটকি মাছের পাইকারি বাজার কাওরানবাজার, যাত্রাবাড়ী এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্র উপকূলবর্তী মহেশখালি, কুতুবদিয়া, রাঙ্গাবালী, চরদুবলা, আফতাবিয়ার, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, কুরুসকুল এলাকায় মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকিতে পরিণত করা হয় সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার নদী ও সমুদ্রে পাওয়া যায় সুস্বাদু সব সামুদ্রিক মাছ। এর মধ্যে চিংড়ি, ছুরি, লইট্টা, পোয়া, চান্দা, ফাইস্যা, কোড়াল, লক্কা, টুনা, চইস্কা, নাইল্লা, ধলছা, সিলং ইত্যাদি মাছ শুঁটকিতে রূপান্তরিত করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার নদী ও খাল বিলের দেশী মাছতো আছেই। জানা গেছে, বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল থেকে আহরিত মাছের একটি অংশ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে আহরিত শুঁটকি মাছ চলে যায় বৃহৎ পাইকারি আড়ৎ চট্টগ্রামের চাকতাইয়ের আসাদগঞ্জসহ বিভিন্ন মোকামে। সেখানে আড়ত হয়ে চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমুদ্র, নদীনালা, খালবিল থেকে আহরিত বিভিন্ন মাছ শুঁটকিতে রূপান্তরিত করার পদ্ধতিটি এখনও অস্বাস্থ্যকর ও সেকেলে। দেশ জুড়ে প্রায় একই পদ্ধতিতে মাছকে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। খোলা মাঠ, বাড়ির উঠোন সমুদ্র উপকূলবর্তী তীর এলাকায় বাঁশ ও মাচা বেঁধে বড় মাছগুলো ঝুলিয়ে দিনের পর দিন রোদে শুকানো হয়। ছোট আকারের মাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় অস্বাস্থ্যকর মেঝেতে। শুকিয়ে ফেলার পর শুঁটকি মাছে শুরু হয় মাছিসহ ক্ষতিকর বিভিন্ন পোকার আক্রমণ। পোকামাকড় শুঁটকি মাছের ভিতর ঢুকে পড়ে অবস্থান করে দীর্ঘ সময়। একপর্যায়ে মাছের ভেতরের হাড়সহ পুরো অংশটিই পোকামাকড় নষ্ট করে ফেলে। এতে মাছের ওজন কমে যায়। আড়ত সংশ্লিষ্টরা কিনতে আগ্রহী হন না। লাভের পুরো অংশ নষ্ট হয়। আর এ থেকে শুঁটকি রক্ষা করতে মৎস্য আহরণকারীরা বেছে নেন কীটনাশক পন্থা। মাছ শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত কীটনাশক সেপ্র করেন শুঁটকিতে। মাছ পচে যাওয়ার আশঙ্কায় কখনও মেশানো হয় ফরমালিন। ফলে শুকনো মাছে পোকার আক্রমণ হয় না। সংরক্ষণ করা যায় দীর্ঘ দিন। স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হয় না কখনও। সেপ্র করা কীটনাশকের কার্যকারিতাও অমলিন থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একজন সহযোগী অধ্যাপক মানবজমিনকে বলেন, খাদ্যে যে কোন কীটনাশক শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দেখা দেয় জটিল সব রোগ। হয়ত প্রক্রিয়াটি ধীরে হয়। কিন্তু এর প্রভাব ভয়াবহ। তিনি বলেন, শুঁটকিতে ডিডিটি ও হেপাটেকলোর মত কীটনাশক মেশানোর বিষয়টি অসচেতনতার কারণেই ঘটছে। যারা করছে এর ক্ষতিকর দিকটি হয়তো তারা জানেন না। তাই মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে না ফেলে শুঁটকি সংরক্ষণ এলাকায় জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই দ্রুত এটি করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সোবহান মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। এতে করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সুস্বাদু খাবার শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে খুব দ্রুত এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।সূত্র : উৎপল রায়,  দৈনিক মানবজমিন 

0 comments:

Post a Comment