ভারত-চীন ব্রহ্মপুত্র সমঝোতা স্মারক থেকে আমাদের শেখার আছে
চীন ও ভারতের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ বিষয়ে সর্বশেষ যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তাতে কি নদীর পানির ওপর তীরবর্তী ভাটির দেশের অধিকারের স্বীকৃতি মেলে? এ সমঝোতা স্মারককে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারতের পানি কূটনীতির এক বড় সাফল্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলেও পানি বিশেষজ্ঞরা সাফ বলে দিয়েছেন, ‘না তা মেলেনি’। বিগত ২৩ অক্টোবর বেইজিংয়ে এ স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আসলে এ সমঝোতা স্মারক হলো দু’দেশের মধ্যে ইতঃপূর্বে স্বাক্ষরিত চারটি দ্বিপক্ষীয় ডকুমেন্টের পরবর্তী স্তর। আগে সই করা ডকুমেন্টগুলো ছিল নি¤œরূপ : ক. গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের মধ্যে ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার কার্যবিধি; খ. চীন কর্তৃক ভারতকে লাংকোয়েন জাংবো/সুটলেজ নদীর বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য ২০১০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক; গ. চীন কর্তৃক ভারতকে ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য ২০১৩ সালের মে মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক; এবং ঘ. ২০১৩ মে মাসের গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের যৌথ ঘোষণা। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিগত ২৩ অক্টোবর সই করা সমঝোতা স্মারকের শর্তগুলো নি¤œরূপ : উভয়পক্ষ স্বীকার করে যে, আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো এবং এদের সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ নদী তীরবর্তী সব দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান অ্যাসেট। উভয়পক্ষ স্বীকার করে নেয় যে, অভিন্ন নদীগুলোর ব্যাপারে সহযোগিতা, পারস্পরিক কৌশলগত সহযোগিতা এবং যোগাযোগের আস্থা বাড়াবে এবং সাথে সাথে কৌশলগত এবং সহযোগিতার অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করবে। উভয়পক্ষ চীন ও ভারতের মধ্যকার আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার ভূমিকা এবং গুরুত্ব মেনে নেয়। ভারত পক্ষ বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদান এবং জরুরি অবস্থা ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার জন্য চীনের প্রশংসা করে। চীনা পক্ষ ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের মে মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে নির্ধারিত জুন মাসের পরিবর্তে মে মাস থেকে প্রদান করতে সম্মত হয়। ২০১৩ সালের সমঝোতা স্মারক অনুসারে এসব তথ্য জুন মাস থেকে দেয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য চীন মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সরবরাহ করবে। উভয়পক্ষ সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি বাস্তবায়ন করবে। ভারতীয় পক্ষ এ ব্যাপারে চীনা পক্ষকে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানায়। দু’পক্ষ অভিন্ন নদী বিষয়ে সহযোগিতা আরো শক্তিশালী করার ব্যাপারে একমত হয় এবং বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদান, জরুরি ব্যবস্থাপনা এবং পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে মতবিনিময়ের এই সহযোগিতা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার কাঠামোর ভিত্তিতে করতে সম্মত হয়। স্বাক্ষর প্রদানের সাথে সাথেই এই সমঝোতা স্মারক চালু হয়েছে এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে তা সংশোধন বা পরিবর্তন করা যাবে। ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা এই সমঝোতা স্মারক নিয়ে যে ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে তাকে ‘অবান্তর ও ভ্রমাত্মক’ আখ্যায়িত করলেও সাথে সাথে এ কথাও বলেছে যে, ‘এতে আশান্বিত হওয়ার একটা মজার লক্ষণ রয়েছে।’ ভারত ইউনিয়ন সরকারের সাবেক সেচ (পানিসম্পদ) সচিব, বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় পানি বিশেষজ্ঞ ও পানিকর্মী, রামাস্বামী আয়ার আরো বলেছেন- ‘বন্যা সম্পর্কিত কতক তথ্যের বিষয় বাদ দিলে নদী বিষয়ে ভারত-চীন সমঝোতা স্মারকে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।’ ভারতের পানিকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে ‘ওয়াটারওয়াচ’ গ্রুপের কাছে দেয়া এক নোটে তিনি লিখেছেন, সমঝোতা স্মারকে উল্লিখিত স্বীকৃতি- আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো এবং এদের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ নদী তীরবর্তী সব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান অ্যাসেট; কোনো দুনিয়া কাঁপানো কিছু নয়। ‘আমি মনে করি চীনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, সে নিজেকে ছাড়াও অন্য নদী তীরবর্তী দেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু এই স্বীকৃতির কারণে চীনের ওপর কোনো প্রতিশ্রুতির দায়দায়িত্ব বর্তায় না।’ রামাস্বামী আয়ারের মতে, স্মারকে উল্লেখিত ‘পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে মতবিনিময়’ বড় কিছু গুরুত্ব বহন করে না। এর মধ্যে ভারতকে (বা চীন) তার স্বার্থবিষয়ক কিছু উত্থাপন করতে বারণ করার মতো কিছু নেই এবং কোনো পক্ষ কোনো বিষয় উত্থাপন করলে, অন্য পক্ষকে তার জবাবে কিছু বলতে হবে। এটুকু কাজের জন্য সমঝোতা স্মারকের দরকার হয় না। তার মতে, ‘মতবিনিময়ের’ অর্থ মতৈক্যে পৌঁছানো বোঝায় না। মতের বিভিন্নতা ও বিনিময় হতে পারে। ভারত বলতে পারে, ‘আমরা তোমাদের প্রকল্পগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন’ এবং চীন উত্তরে ‘এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ বলে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এটাও হবে মতবিনিময়! ভারতের এই সাবেক সেচ সচিব তার বক্তব্যের সমাপ্তি টেনেছেন আরো তীè ভাষায়। ‘আমি অবাক হয়ে যাই যে এই সমঝোতা স্মারককেও ‘বড় সাফল্য’ বা ‘দিগন্ত উন্মোচন’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এজন্য দরকার ছিল প্রকল্প পরিকল্পনা (বিস্তারিত টেকনিক্যাল ব্যাখ্যাসহ) ভারতকে পূর্বাহ্নে অবগত রাখা এবং তা নিয়ে পরামর্শ করার প্রতিজ্ঞা, যেন ভারতের উৎকণ্ঠা যথাযথভাবে বিবেচিত হয় এবং ভারতের ক্ষতি হয় এমন কিছু না করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আমি এর কিছুই দেখছি না। কাজেই কেউ কি এমন মতপোষণ করতে পারে, অভিন্ন নদীর ব্যাপারে সহযোগিতার এই একাত্মতা এ ধরনের কিছু অর্থবহন করে? আমি এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করি।’ ভারত ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের জন্য বিশাল গুরুত্ব বহন করে এবং এ জন্য তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল দিয়ে নেমে আসা নদীগুলোর সর্বশেষ ভাটির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং উজানে অবস্থিত দেশগুলোর (চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটান) নদী বিষয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর পড়তে বাধ্য। নদীগুলোর প্রবাহ বাংলাদেশের ওপর দিয়েই সাগরে গিয়ে পড়ে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রামাস্বামী আয়ারের উল্লিখিত শর্তগুলোর কোনটিই আমাদের সর্ববৃহৎ বা বলতে গেলে একমাত্র নিকট প্রতিবেশী ভারতের সাথে পানি কূটনীতিতে নেই। ৩০ বছরের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিতে এই নদীর উজানে প্রকল্প পরিকল্পনা (বিস্তারিত টেকনিক্যাল ব্যাখ্যাসহ) বাংলাদেশকে পূর্বাহ্নে অবগত রাখা, তা নিয়ে পরামর্শ করার প্রতিজ্ঞা এবং বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা যথাযথভাবে বিবেচনা করার কোনো বিধান বা প্রতিশ্রুতি নেই। নদীর উজানে প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের বক্তব্য প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। ফারাক্কা পয়েন্টে ভাগাভাগির জন্য যেন বাংলাদেশের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ বজায় থাকে তা নিশ্চিত করার কোনো বাধ্যবাধকতা প্রতিবেশী ভারতের নেই। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকার কর্মরত থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, যারা ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পানি না পাওয়ার ব্যাপারে আওয়াজ তুলছেন তারা পানি বণ্টন চুক্তিটাই বোঝেন না। ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণে পানি এলেই তো বণ্টনে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, কিছুকাল যাবত হিমালয়ের বরফ যথেষ্ট পরিমাণে না গলায় গঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহ ফারাক্কা পর্যন্ত যথেষ্ট ছিল না। তার এ বক্তব্য ঢাকার পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের পানির হিস্যা ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত প্রবাহের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল, এ কথায় অর্থ দাঁড়ায়, ফারাক্কায় পানির প্রাপ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোনো পথ বাংলাদেশের নেই। উজানে কী প্রকল্প নেয়া বা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এ ধরনের কোনো তথ্য বাংলাদেশকে জানাবার ব্যবস্থা অনুপস্থিত এবং সেসব প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা জানাবার কোনো উল্লেখ চুক্তিতে নেই। অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির শর্ত নিয়ে টানাপড়েনে। তিস্তা নদীর উজানে ইতোমধ্যেই বহু পানি প্রত্যাহারের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতের একমাত্র সিকিম রাজ্যেই এ ধরনের অন্তত ছয়টি পানি-স্থাপনা আছে। সেখান থেকে পাহাড়ি সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের খ্যাতনামা পানিকর্মী ও লেখক অঞ্জল প্রকাশ সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক কর্মশালায় বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কী পরিমাণ পানি বাংলাদেশে প্রবাহ হবে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ব্যবস্থাপনায় তীরবর্তী দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ ও পানি-কর্মীদের মধ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দুই দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা এখনো তিস্তার বাংলাদেশ অংশে কী পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে সে বিষয়ে অনুমানভিত্তিক শতাংশের হিসাবের ওপর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। উজানে যেসব পানি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে আশঙ্কা থাকলে তা ব্যক্ত না করে এবং আশঙ্কা নিরসনের কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া ছাড়াই আলোচনা চলছে। উজানে প্রত্যাহের পর তিস্তার অবশিষ্ট পানি দিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন মিটবে কিনা বা তা তিস্তা নদীকে জীবন্ত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে কিনা, এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হচ্ছে না। এই ধারণার সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে ভারতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ নিয়ে আলোচনায়। এ ড্যামের ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে ওই স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে ভারত কর্তৃক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাস্তবায়নের পর্যায়ে পৌঁছাবার পর। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অভিন্ন নদীর ওপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ড্যাম নির্মাণের কী বিরূপ পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিপর্যয় বরাক (মেঘনা) নদীর নি¤œাঞ্চল বাংলাদেশ হতে পারে তা নিরূপণ এতদিন করা হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার পরিবেশগত প্রভাবের ওপর কাজ করছে। ভারতের তরফে বলা হয়েছে, এই ড্যাম থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের অংশ বাংলাদেশকে দেয়া হবে। এ জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে আহ্বান করা হয়েছে। বাংলাদেশের পানি কূটনীতি এখনো এ দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের সাথে সাযুজ্য রেখে সাজানো হয়নি। বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা এখনো তাদের কথাবার্তায় এটা প্রতিফলিত করতে পারছেন না যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই অবদান। এখানকার জীবনজীবিকা নদীপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রাকৃতিক প্রবাহগুলোর ওপর ভারসাম্যহীন হস্তক্ষেপ তাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং এসবের ওপর নির্ভরশীল জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির বাংলাদেশ জনগোষ্ঠী এক কঠিন বিপাকে পড়বে। নদ-নদীগুলো যদি মনে যায় বা এগুলোকে শুধু বর্তমানের প্রয়োজনে হত্যা করা হয় এবং এর ফলে বাংলাদেশে জীবনজীবিকা বাধাগ্রস্ত হয়, তার প্রতিক্রিয়া পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বা দেশে পড়তে বাধ্য। এ কারণে যদি বাংলাদেশে পরিবেশ সৃষ্ট বাস্তুহারার সংখ্যা বেড়ে যায়, তাদের বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া যতই উঁচু হোক না কেন এভাবে সৃষ্ট বাস্তুহারাদের বাঁধভাঙা ঢল কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিষয়টা ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের কাছে দিবাগুলোকের মতো পরিষ্কার। কিন্তু এ বিষয়ের গভীরতা সেখানকার নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরও উপলব্ধিতে এখনো আনা যায়নি। বাংলাদেশের তরফ থেকেও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই প্রেক্ষিতে অক্টোবরে স্বাক্ষরিত ভারত-চীন সমঝোতা স্মারক খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই সমঝোতা স্মারকের শর্ত পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা দুই প্রতিবেশী বন্ধু দেশের মধ্যে অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথার্থ অবস্থান নিতে সহায়তা পাবেন। সর্বশেষ এই স্মারক সই করার আগে ভাটির দেশ ভারত উজানের দেশ চীনের সাথে চার-চারটি ডকুমেন্ট স্বাক্ষর করেছিল। প্রত্যেকটি পূর্বেরটির চেয়ে উন্নততর। এখনো ব্রহ্মপুত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী চুক্তি হয়নি। তবে বর্তমান স্মারক ভবিষ্যতে একটি টেকসই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই স্মারক সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতের সাথে আমাদের অবস্থানের পর্যালোচনা করার। কিভাবে ভাটির দেশ হয়েও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী উজানের দেশের সাথে বোঝাপড়া করে এগোনো যায়। শক্তির ভারসাম্যে অসম অবস্থানে থেকেও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তবে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর তীরবর্তী সব দেশের এ কথা উপলব্ধি করা উচিত যে, প্রকৃতির নদীগুলোকে ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে শাসন করা হবে এগুলোকে হত্যা করার শামিল। নদীগুলো তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে সাগর পর্যন্ত জীবন্ত না থাকলে এদের সেবাও পাওয়া যাবে না। ভারসাম্যহীন পানি প্রত্যাহারের ফলে জীবনীশক্তি কমার সাথে সাথে নদীগুলো তাদের সেবা দেয়ার ক্ষমতা হারাতে থাকবে এবং এক সময় মরে যাবে। বিপন্ন হবে পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীবন, জীবিকা এবং জনপদ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থা কেমন ভয়াবহ হবে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা দরকার। তার জন্য বিদেশ যেতে হবে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে গঙ্গানির্ভরশীল এলাকায় কী ঘটেছে তা সেখানকার জনগণকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। এই অঞ্চলে দুই ডজনের বেশি নদী বিগত চার দশকে মরে গেছে।
সূত্র- নয়াদিগন্ত, লেখক : সম্পাদক, দৈনিক গ্রিনওয়াচ, ঢাকা।
0 comments:
Post a Comment