Wednesday, January 1, 2014

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ - বিদেশী হায়েনা ও দেশীয় সিন্ডিকেটের কবলে

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সিন্ডিকেটের কবলে

 বাংলাদেশের ভূ-অভ্যšত্মরের সমতলে ও সমুদ্রবক্ষের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, বিপণনসহ কর্তৃত্ত্বের ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বব্যাপী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বহুজাতিক ও মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করার কূট চাল চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও মার্কিন কূটনৈতিকরা পৃথিবীর দেশে দেশে অবস্থান করে দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে।



বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে বিদেশি কোম্পানিগুলো করাল থাবা বসিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের আšত্মর্জাতিক দরপত্র আহবান করে বাংলাদেশ, এই দরপত্র আহবান করার পর আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো শর্তের অজুহাতে দরপত্রে অংশগ্রহণ করেনি এবং এশীয় অঞ্চলের অন্য কোন কোম্পানি যাতে অংশগ্রহণ না করে এই জন্যও তারা গোপন তৎপরতা চালায় বলে শোনা গেছে। তাই বাংলাদেশের আহবানকৃত দরপত্রে কোন কোম্পানি অংশ নেয়নি। ফলে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কোন আšত্মর্জাতিক কোম্পানিকে কাজে লাগাতে পারেনি। আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ সরকারকে দরপত্রের শর্ত শিথিল করার আহবান জানায়। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নেতৃত্ত্ব সরকারের কাছে আবেদন জানায় যে, আহরিত তেল-গ্যাস তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে এমন শর্ত আরোপ করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের জন্য। বাংলাদেশ সরকার যদি আšত্মর্জাতিক কোম্পানির এই আবদার মেনে পুনরায় দরপত্র আহবান করে তাহলে বাংলাদেশকে গাধার মতো মিঠাইয়ের বোঝাই বহন করা হবে মিঠাইয়ের স্বাদ আর গ্রহণ করতে পারবে না। বিশেষ করে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানি চাইছে বাংলাদেশের সমুদ্রগভীরে রক্ষিত গ্যাসের একচ্ছত্র আধিপত্য। তা যদি না হতো তাহলে তারা কিভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির শর্ত উল্লেখ করে পুনরায় বাংলাদেশকে দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানায়।

এদিকে বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটে ভুগছে। লোডশেডিংয়ে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই বা¯ত্মবতায় বাংলাদেশের জ্বালানিসম্পদ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার শর্ত কিভাবে সরকার গ্রহণ করবে? আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্র¯ত্মাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার সংশোধিত উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এই নমনীয়তার কারণে সমতলের গ্যাস আহরণকারী আšত্মর্জাতিক মার্কিন কোম্পানি শেভরণ দেশের অন্যতম গ্যাস ক্ষেত্র বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজারের গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কিছু শর্ত শিথিল করার জন্য পেট্রোবাংলাকে চাপ দিচ্ছে। জানা গেছে পিএসসিতে গ্যাসের দাম কম ধরায় ও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করার কথা উল্লেখ না থাকায় তাদের এই আপত্তি। আšত্মর্জাতিক কোম্পানি এই দেশের গ্যাস নিয়ে যে বাণিজ্য করছে তা দেখে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির আহরিত গ্যাস সরকার যে দামে কিনে তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি দামে সরকারকে গ্যাস কিনতে হয় আšত্মর্জাতিক কোম্পানির আহরিত গ্যাস অথচ উভয় কোম্পানি বাংলাদেশের ভূগর্ভ থেকে গ্যাস আহরণ করে। আমরা যে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় গ্যাস পাই এই গ্যাস পেট্রোবাংলা বাপেক্সের কাছ থেকে কিনে প্রতি হাজার ঘনফুট ৭ টাকা করে আর আšত্মর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কিনে প্রতিহাজার ঘনফুট ৩ ডলার করে। উপরš‘ আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। আমাদের দেশে তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে আর তাদের ট্যাক্স আমাদেরকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে তাছাড়া আšত্মর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করা গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারের মাধ্যমে ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ পড়ে। নিয়তির কি পরিহাস আমাদের দেশের সম্পদ আমাদের রিজার্ভ ব্যয় করে বিদেশ থেকে আমদানি করা দ্রব্যের মতো আমাদেরকেই কিনতে হচ্ছে। আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারকে প্রতি বছর ২০০০ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিষয়টা অনেকটা নিজভূমে পরবাসের মতো। বাংলাদেশ থেকে ৩০ গুণ বেশি দাম নেয়ার পর আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর তৃপ্তি হচ্ছে না তাদের আরও চাই, বর্তমানে আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলো চাইছে আহরণ করা সম্পূর্ণ গ্যাস পা¯ত্মুরিত করে তারা যেন তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারে সরকার যেন তাদের এই অনুমোদনটাই দেয়। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নেতৃত্ত্ব আšত্মর্জাতিক কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করে আবেদন করেছেন যে, সমুদ্রপৃষ্ঠে তাদের আহরিত গ্যাসের দাম বাড়াতে এবং কোম্পানির অংশের গ্যাস বাজার দর অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে। যেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না, তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক উৎপাদন কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে তাছাড়া গ্যাস সংকটে দেশের চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া উৎপাদন কমে গেছে। চাহিদার প্রায় একদশমাংশ ইউরিয়া বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে। এ খাতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেভরনের এই প্র¯ত্মাব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? বাজার দর অনুসারে গ্যাস বিক্রি করলে কেন তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে হবে? কেন বাংলাদেশের কাছে নয়? কেন মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ থেকে গ্যাস আহরণ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করতে চায় না কেন? পেট্রোবাংলাকে কি শেভরন জিম্মি করে ফেলেছে? শেভরনের আচরণ দেখে মনে হয় মার্কিন এই কোম্পানিটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানার শিকড় প্রোথিত করে বসে আছে। আর এই কোম্পানিটির প্রভাবে এশীয় অঞ্চলের কোন কোম্পানি দরপত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের গভীরসমুদ্রের তেল-গ্যাস আহরণের দরপত্রে মার্কিন কোম্পানি শেভরন চাচ্ছে সমুদ্রের আহরিত গ্যাস তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার অধিকার। অথচ বাংলাদেশের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের ৫০ বছরের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে (যদি শতকরা ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়) তাহলে দরকার প্রায় ১১০ টিসিএফ গ্যাস। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমানে আছে ৭-৮ টিসিএফ। আমরা কয়লাকে যদি এই হিসাবের আওতায় এনে হিসাব করি তাহলে হবে ৩৫-৪০ টিসিএফ যদিও কয়লা নিয়ে এশিয়া এনার্জিও কুচাল অব্যাহত রয়েছে। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, আরও প্রয়োজন ৬০-৭০ টিসিএফ গ্যাস বর্তমানে যে গ্যাস মজুদ আছে তা থেকে প্রায় ১০ গুণ গ্যাসের প্রয়োজন হবে। এই গ্যাসের জন্য বাংলাদেশকে পুরোপুরি বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এর ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের আহরিত গ্যাস কোন ক্রমেই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা যাবে না। যদি সংশোধিত পিএসসিতে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করার এমন ধারা সংযোজন করা হয় তা হবে দেশের জন্য আত্মঘাতী। শেভরনসহ বিদেশি কোম্পানিগুলো চাইবে আšত্মর্জাতিক বাজারে গ্যাস বিক্রি করতে। কারণ এখানে তাদের দুই ধরনের লাভ নিহিত আছে এক অধিক মুনাফা অজর্ন দুই আধিপত্য বি¯ত্মার। বাংলাদেশ যদি বিদেশি কোম্পানির সিন্ডিকেটে প্র¯ত্মাবিত ধারাগুলো পিএসসিতে সংযোজন করে তাহলে এই দেশও নাইজেরিয়ার রূপ লাভ করবে। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানির সিন্ডিকেটে ঘেরাটোপে বাংলাদেশ ক্রমশই জড়িয়ে পড়ছে আর এর ফলে এই বিদেশি কোম্পানিগুলো আšত্মর্জাতিক দরপত্রে মনোপলি আচরণ করেই যাচ্ছে। তাছাড়া মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কূটনৈতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকা-ের নিয়ামকের স্থান দখল করে নেয়ায় সরকারি ও প্রধান বিরোধীদল তাদের তোষামোদ করে এবং তাদের দিক নির্দেশনা মেনে রাজনীতি পরিচালনা করে। দেশের রাজনৈতিক অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে এই কূটনৈতিকরা হ¯ত্মক্ষেপ করে থাকে। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে কোটি কোটি টাকার মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানায় বিদেশি কোম্পানিরা ভাগ বসাতে শুর“ করে জোট- মহাজোটের আমল থেকে, ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে প্রথম শুর“ হয় গ্যাস ক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া, বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোকে বিভিন্ন বস্নকে ভাগ করে বিভক্ত করা হয়েছে। আর বিএনপি সরকার সেই সময় ১৫, ১৬নং বস্নক কেয়ার্ন এনার্জি-হল্যান্ড সি-সার্চকে। বস্নক ১২, ১৩ ও ১৪ অক্সিডেন্টালকে। বস্নক ১৭, ১৮ অকল্যান্ড রেক্সউডকে। বস্নক ২২ ইউনাইটেড মেরিডিয়ান করপোরেশনকে ইজারা দিয়ে দেয়। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সেই ধারা অব্যাহত রাখে। আওয়ামী লীগ সরকার এখানে ব্যতিক্রম হিসেবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে নামমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে সংযোজিত করে। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার বস্নক ৫, ১০ শেল-কেয়ার্ন এনার্জি- বাপেক্সকে, বস্নক ৯ টাল্লো-শেভরন-টেক্সকো-বাপেক্সকে, বস্নক ৭ ইউনিকল বাপেক্সকে ইজারা দেয়।

এভাবেই বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে কর্তৃত্ব করতে শুর“ করে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্স ত্রিমাত্রার ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির পরিত্যক্ত করে রাখা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কারের মতো অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। কুমিল্লার শ্রীকাইলসহ দেশের অনেক স্থানে গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর মেধাকে কেন সরকার কাজে না লাগিয়ে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর হচ্ছে তা কিš‘ জনমনে প্রশ্ন নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতির জোগান দিতে পারলে তারা বিদেশিদের চাইতে বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হবে। তাই সরকারের উচিত বিদেশিদের ঘেরাটোপের সিন্ডিকেট কবল থেকে দেশের প্রাকৃতিকসম্পদকে রক্ষা করা। তা করার জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সমুদ্রবক্ষের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের কাজে লাগাতে হবে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের যে রিজার্ভের বিনিময়ে দেশের গ্যাস বিদেশিদের কাছ থেকে কিনতে হয় সেই বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
সূত্র - শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : দৈনিক আমাদের সময় ।

0 comments:

Post a Comment