সত্য জানি, সত্য মানি এবং সত্যের সাথে থাকি। সকল খবর হোক সত্য ও নিরপেক্ষ।

সত্যকে অস্বীকার কারনে, গত চার দশকে জাতি হিসাবে আমরা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারিনি । স্বাধীনতার প্রায় অধ শতাব্দীতে জাতি তার কাঙ্তিত সাফল্য পায়নি।

মোর নাম এই বলে ক্ষ্যাত হোক – আমি তোমাদেরই লোক

যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ জাতি সমৃদ্ধিলাভ করেছে - আমরা তাদের ভুলব না । তোমরা অমর হয়ে থাকবে জাতীর ভাগ্যাকাশে। আমাদের ভালবাসা ও দোয়া রইল।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষা হোক সবার জন্য উম্মুক্ত ও সহজলভ্য।

পযটন হোক – জাতীয় উন্নতির একমাত্র হাতিয়ার।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, নীলগিরি সহ হাজারো দৃষ্টি নন্দন অপার সৌন্দার্য ছড়িয়ে আছে এ জমিনে – জানি ও সমৃদ্ধ করি দেশমাতৃকাকে।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে / এছাড়াও আমরা ডোমিন- হোষ্টিং বিক্রি /আপনার সাইটের ভিজিটর বাড়ানো / সাইটিকে কে গুগল টপে আনতে আমাদের সাহায্য নিন।

Saturday, January 18, 2014

শুঁটকিতে বিষ - মানুষ শখ করে খাবে কি ?

শুঁটকিতে বিষ!


শুঁটকি মাছ! জিভে পানি আসার মতো খাবার। এই খাবারটি খেতে পছন্দ করে না এমন লোক খোঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু সাবধান! সুস্বাদু এই খাবারে মেশানো হয় কীটনাশক, বিষাক্ত রাসায়নিক। যা মানবদেহে প্রবেশ করে দেখা দিতে পারে জটিল সব রোগ। ত্বরান্বিত হতে পারে মৃত্যু। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা, পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা ও দীর্ঘদিন তা সংরক্ষণের জন্য শুঁটকিতে মেশানো হয় এনড্রিন, বাসুডিন, এগস, ডাইমেক্রন, হেপাটেকলোর, ডিডিটি পাউডার, গ্যার্মোক্সিন পাউডার সহ মারাত্মক সব বিষাক্ত কীটনাশক। শুধু তাই নয়, শুঁটকি যাতে পচে নষ্ট না হয় সে জন্য মেশানো হয় ফরমালিনসহ বিষাক্ত রাসায়নিক। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের খাদ্য ও বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির নিউটিশান অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কে এম ফরমুজুল হকের তত্ত্বাবধানে সমপ্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছকে শুঁটকিতে পরিণত করে তা দীর্ঘ দিন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয়। মাছি পোকা যাতে শুঁটকির ভেতর প্রবেশ করতে না পারে এজন্য শুঁটকিতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে গবেষক ড. ফরমুজুল হক মানবজমিনকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি জমি পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যে সব কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় ঠিক একই কায়দায় শুঁটকি মাছ সংরক্ষণ করতেও তা ব্যবহার হচ্ছে। এই কীটনাশকের কার্যকারিতা কখনও নষ্ট হয় না। খাওয়ার সঙ্গে তা শরীরে প্রবেশ করে ‘নীরব গণহত্যা’ চালাচ্ছে। তিনি বলেন, যারা এগুলো করছে তারা হয়তো না বুঝে সচেতনতার অভাবে করছে। তাই প্রয়োজন গণসচেতনতা তৈরি করা। বিষয়টি ভয়াবহ আকারে রূপ নেয়ার আগেই মৎস্য আহরণ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে সবাইকে বোঝানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমি নিজেও এ বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি সবার আগে প্রয়োজন দেশে মৎস্য আহরণ ও তা সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে আধুনিকীকরণ করা। ড. ফরমুজুল বলেন, মালয়েশিয়ার মানুষ আমাদের চেয়ে বেশি পরিমাণ শুঁটকি সংরক্ষণ করে। তাদের খাদ্য তালিকায় শুঁটকির পরিমাণও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তাদের শুঁটকিতে উৎকট গন্ধ থাকে না। যেটি আমাদের দেশের শুঁটকিতে থাকে। মালয়েশিয়ায় মৎস্য আহরণ, শুঁটকিতে রূপান্তর ও তা সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বেশ আধুনিক। খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, শুঁটকিতে মেশানো কীটনাশকজাতীয় বিষের কার্যকারিতা থাকে দীর্ঘ দিন। এমনকি রান্নার পরও এর কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। ফলে শরীরে তা প্রভাব পড়ে। দেখা দেয় বিভিন্ন জটিল রোগ। তারা বলছেন, এসব কীটনাশক ও রাসায়নিক মেশানো শুঁটকি মাছ খেয়ে মানবদেহে যে সব রোগ বা রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে তার মধ্যে রক্ত শূন্যতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, চোখ ও ত্বকে জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট, জন্ম বিকলাঙ্গতা, নিদ্রাহীনতা সহ ক্যান্সার, জন্ডিস, হার্ট অ্যাটাক, লিভার ড্যামেজ ও মরণব্যাধি ক্যান্সারের মত মারাত্মক সব রোগ। মৎস্য অধিদপ্তর ও রাজধানীর সবচেয়ে বড় শুঁটকি মাছের পাইকারি বাজার কাওরানবাজার, যাত্রাবাড়ী এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্র উপকূলবর্তী মহেশখালি, কুতুবদিয়া, রাঙ্গাবালী, চরদুবলা, আফতাবিয়ার, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, কুরুসকুল এলাকায় মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকিতে পরিণত করা হয় সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার নদী ও সমুদ্রে পাওয়া যায় সুস্বাদু সব সামুদ্রিক মাছ। এর মধ্যে চিংড়ি, ছুরি, লইট্টা, পোয়া, চান্দা, ফাইস্যা, কোড়াল, লক্কা, টুনা, চইস্কা, নাইল্লা, ধলছা, সিলং ইত্যাদি মাছ শুঁটকিতে রূপান্তরিত করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার নদী ও খাল বিলের দেশী মাছতো আছেই। জানা গেছে, বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল থেকে আহরিত মাছের একটি অংশ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে আহরিত শুঁটকি মাছ চলে যায় বৃহৎ পাইকারি আড়ৎ চট্টগ্রামের চাকতাইয়ের আসাদগঞ্জসহ বিভিন্ন মোকামে। সেখানে আড়ত হয়ে চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমুদ্র, নদীনালা, খালবিল থেকে আহরিত বিভিন্ন মাছ শুঁটকিতে রূপান্তরিত করার পদ্ধতিটি এখনও অস্বাস্থ্যকর ও সেকেলে। দেশ জুড়ে প্রায় একই পদ্ধতিতে মাছকে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। খোলা মাঠ, বাড়ির উঠোন সমুদ্র উপকূলবর্তী তীর এলাকায় বাঁশ ও মাচা বেঁধে বড় মাছগুলো ঝুলিয়ে দিনের পর দিন রোদে শুকানো হয়। ছোট আকারের মাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় অস্বাস্থ্যকর মেঝেতে। শুকিয়ে ফেলার পর শুঁটকি মাছে শুরু হয় মাছিসহ ক্ষতিকর বিভিন্ন পোকার আক্রমণ। পোকামাকড় শুঁটকি মাছের ভিতর ঢুকে পড়ে অবস্থান করে দীর্ঘ সময়। একপর্যায়ে মাছের ভেতরের হাড়সহ পুরো অংশটিই পোকামাকড় নষ্ট করে ফেলে। এতে মাছের ওজন কমে যায়। আড়ত সংশ্লিষ্টরা কিনতে আগ্রহী হন না। লাভের পুরো অংশ নষ্ট হয়। আর এ থেকে শুঁটকি রক্ষা করতে মৎস্য আহরণকারীরা বেছে নেন কীটনাশক পন্থা। মাছ শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত কীটনাশক সেপ্র করেন শুঁটকিতে। মাছ পচে যাওয়ার আশঙ্কায় কখনও মেশানো হয় ফরমালিন। ফলে শুকনো মাছে পোকার আক্রমণ হয় না। সংরক্ষণ করা যায় দীর্ঘ দিন। স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হয় না কখনও। সেপ্র করা কীটনাশকের কার্যকারিতাও অমলিন থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একজন সহযোগী অধ্যাপক মানবজমিনকে বলেন, খাদ্যে যে কোন কীটনাশক শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দেখা দেয় জটিল সব রোগ। হয়ত প্রক্রিয়াটি ধীরে হয়। কিন্তু এর প্রভাব ভয়াবহ। তিনি বলেন, শুঁটকিতে ডিডিটি ও হেপাটেকলোর মত কীটনাশক মেশানোর বিষয়টি অসচেতনতার কারণেই ঘটছে। যারা করছে এর ক্ষতিকর দিকটি হয়তো তারা জানেন না। তাই মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে না ফেলে শুঁটকি সংরক্ষণ এলাকায় জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই দ্রুত এটি করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সোবহান মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। এতে করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সুস্বাদু খাবার শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে খুব দ্রুত এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।সূত্র : উৎপল রায়,  দৈনিক মানবজমিন 

Friday, January 3, 2014

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর - আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

সায়ীদ স্যারের সঙ্গে এক সকাল


Untitled-1আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখান মানুষকে। দেশে যখন তীব্র হতাশা ও স্থবিরতা, সেই মুহূর্তে তিনি শোনালেন আশা ও সম্ভাবনার কিছু কথা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন আনিসুল হক
পৌষের সকালটা চমৎকার। ঝকঝক করছে রোদ্দুর। বসে আছি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বাসভবনে। জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে, গ্রিলের ছায়া মেঝে আর দেয়ালে এঁকেছে জাফরিকাটা নকশা। বছরের শেষ দিনটার সক্কালবেলা হাজির হয়েছি তাঁর সন্নিধানে।

এসেছি নতুন বছরের জন্য একটুখানি উদ্দীপনা নিতে। দেশের রাজনৈতিক হানাহানি বড় বেশি দাম নিয়ে নিচ্ছে। সামনে বইমেলা, প্রকাশকেরা যোগাযোগ করছেন, আমার দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। বইমেলা কি আদৌ হবে? নিকানোর পাররা, চিলির বর্ষীয়ান কবি, একবার বলেছিলেন, কাকে বলে কবিতা, যদি না বাঁচে দেশ। খুব হতাশ লাগে।

স্যারকে বলি, ‘স্যার, আমাকে আপনি উপদেশ দিয়েছিলেন, আশার কথা লিখবে। কারণ, আশা লাভজনক। আপনার সে অনুরোধ আমি ভুলিনি, জনাব। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, এই হানাহানি-সংঘাতের মধ্যে হতাশ না হয়ে উপায় আছে। এবার কী বলবেন, স্যার?’
স্যার বলেন, ‘চসারের ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা কাহিনিকাব্যের শেষ দিকে একটা অংশ আছে। অনেক দ্বন্দ্ব-হানাহানি শেষে স্বর্গে গেছে ট্রয়লাস। সেখানে গিয়ে স্বর্গের অনেক উঁচু থেকে তাকিয়েছে পৃথিবীর দিকে। তাকাতেই তার মনে হলো, সংগ্রাম আর দ্বন্দ্বমুখর মানুষের এই পৃথিবী কত তুচ্ছ, সামান্য। কত ছোট স্বার্থ, লোভ—ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া নিয়ে হানাহানি করে মরছে মানুষ। ট্রয়লাসের মতো আমরা যদি একটু দূরে গিয়ে জীবনের দিকে তাকাই, তবে আজকের এই হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে হয়তো অত বড় মনে হবে না। আমরা যেন না ভুলি, ইতিহাসে আমাদের কোনো দিন নিজেদের রাষ্ট্র ছিল না। আমরা কোনো দিন স্বাধীন ছিলাম না। আমরা পুরোপুরি রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতাহীন জাতি। এই প্রথম রাষ্ট্র পেয়েছি। সবে বুঝতে শুরু করেছি একটি ন্যায়সম্মত আধুনিক রাষ্ট্র কী। কী করে তা চালাতে হয়। এ নিয়ে গোটা জাতি কম চেষ্টা করছে না। সব দেশই কোনো না কোনো সময় এ রকম সংকটের ভেতর দিয়ে যায়। ইংল্যান্ডে কত দিন যুদ্ধ হয়েছে। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ হয়েছে বছরের পর বছর। ফরাসি বিপ্লবের সময়ও কত মানুষ নিহত হয়েছে। জনজীবন কীভাবে তছনছ হয়ে গেছে। সে তুলনায় আমরা কত দিকে ভালো করছি।
‘শুধু বিপাকে পড়ে গেছে আমাদের রাজনীতি। জাতি আজ দাঁড়াতে চাচ্ছে, বড় হতে চাচ্ছে, জয় করতে চাচ্ছে। কিন্তু সমস্ত স্বপ্ন ও উদ্যমের বুকের ওপর জল্লাদের মতো চেপে বসেছে রাজনীতি। রাজনীতির এই বিপাকে পড়া শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার জন্য হয়নি। এ হয়েছে মূলত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে; এ ধারার ফলে দলে স্বৈরাচারী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে। এই অনুচ্ছেদের জন্য দুই দশক ধরে আমাদের দেশে চলছে “গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার”। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এক জায়গায়। এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। পারে নির্জলা স্বৈরতন্ত্রে। এ করতে গেলে অনেক রক্তে এর দেনা শোধ করতে হয়। আজ এখান থেকে আমাদের বেরোতে হবে। এ একটা সাময়িক ব্যাপার। যখন ঝড় ওঠে, মনে হয় কোনো দিন এ বুঝি থামবে না। কিন্তু দেখা যায়, একসময় থেমে গেছে। তার পরে আসে এক দীর্ঘ সুন্দর দিন। আমাদের এখানেও তা আসবে। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর দিয়েই সমাধানে আসতে হবে, যেমন এসেছে অগ্রসর জাতিগুলোতে। আমি বিশ্বাস করি, সারা জাতির উৎকণ্ঠা ও শুভবুদ্ধি এ থেকে বেরোনোর পথ বের করে নেবেই।’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আমাদের দেশে দুই রাজনৈতিক পক্ষের সংঘাত কি কেবলই বৈষয়িক? নাকি এর পেছনে আছে দুটো মৌলিক আদর্শের দ্বন্দ্ব—একটা একটু ডান, একটা একটু বাম; বা ধরা যাক বাংলাদেশি বনাম বাঙালি?’
তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন। বলেন, ‘এটা কোন দেশে নেই? সব দেশেই গণতন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত—প্রগতিশীল ও তুলনামূলকভাবে কম প্রগতিশীল। এই দ্বন্দ্ব আদর্শিক ও সর্বকালীন। সব কালের সব দেশের মধ্যে এ ছিল, আছে। প্রাচীন গ্রিসে গণতন্ত্রী-অভিজাততন্ত্রী, রোমে প্লেবিয়ান-প্যাট্রিসিয়ান, এ যুগের আমেরিকায় ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান, যুক্তরাষ্ট্রে কনজারভেটিভ-রিপাবলিকান এবং ভারতে কংগ্রেস-বিজেপি তো এই দ্বন্দ্বেরই রাজনৈতিক রূপ। সহিংসতা সব দেশেই আছে। কিন্তু আমাদের মতো সহিংসতা ও সংঘাত আশাপাশের গণতন্ত্রগুলোতে এভাবে নেই। কারণ, ওসব দেশের গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের ক্ষমতা গণতন্ত্রের পরিধির মধ্যে সীমিত। অন্যদিকে, আমাদের নেতৃত্বের ক্ষমতা গণতন্ত্রের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে আছে। আমাদের দলপ্রধানেরা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠার ফলেই আমাদের রাজনীতি এমন সংঘাতপূর্ণ ও সহিংস হয়ে উঠেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আসতে হয় বলে স্বৈরতন্ত্রী দেশগুলোতে স্বৈরতন্ত্র থাকে একটি। কিন্তু আমাদের “গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রীদের” ক্ষমতায় আসতে হয় জনগণের ভোটে। এই জনগণ আবার এক দলকে দুবার ক্ষমতায় আনে না। তাই স্বৈরতন্ত্র এ দেশে হয়ে পড়েছে দুটি। চিরকাল স্বৈরতন্ত্রের মূল প্রবণতা দেশে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এরাও তা-ই করছে—দুই বৈরী পতাকার নিচে দেশের জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করে পরস্পরকে ধ্বংসের মাধ্যমে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এ কারণে গণতন্ত্র হয়ে উঠছে আরও সংঘাতময়।’
এবার স্যারকে আসল কথাটা বলি, ‘সেদিন কুদ্দুস বয়াতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা মারা যাচ্ছি। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা কোনো অনুষ্ঠান করতে পারছি না। আমি নিজে লিখতে বসতেই পারছি না। আপনার কাছে এসেছি স্যার পুনরুজ্জীবিত হওয়ার জন্য। আপনি এই সময়গুলোতে কী করেন?’
স্যার বলেন, ‘পৃথিবীতে দুই রকম প্রাণী আছে—উষ্ণ রক্তের প্রাণী ও শীতল রক্তের প্রাণী। শীতল রক্তের প্রাণীর তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে ওঠানামা করে। গরমকালে সে জেগে ওঠে আর শীতকালে শীতনিদ্রায় যায়। আবার উষ্ণ রক্তের প্রাণী—মানুষ, হরিণ, বাঘ—বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে এদের ভেতরের তাপমাত্রার ওঠানামার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ধারণা, আমি উষ্ণ রক্তের মানুষ। বাইরে কী হলো না হলো সেটা নিয়ে আমি যদি ক্রমাগত আশান্বিত বা বিমর্ষ হতে থাকি, তবে তো কাজ করতে পারব না। তাই বাইরের পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে গেলেও আমি কাজ করে যাই। অন্য পক্ষে বললে এই মন খারাপ করে থাকারও একটা লাভ আছে। উদ্দীপিত অবস্থায় কেউ হয়তো “বিদ্রোহী”র মতো কবিতা লিখে ফেলবে। যা-ই ঘটুক আমার কাজের মধ্যে আমি পরিপূর্ণভাবে নিমগ্ন থাকতে চাই। প্লেটোর রিপাবলিক-এর একটি কথা এ ব্যাপারে অল্প বয়সে আমায় খুবই প্রভাবিত করেছিল। সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দেশপ্রেম কী? জবাবে সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। আমাদের সবাইকে আগে নিজের কাজটা সুন্দরভাবে করতে হবে।’
সায়ীদ স্যারের সঙ্গে এক সকাল কাটিয়ে তাঁর ফ্ল্যাট থেকে নেমে আসি আমরা। স্যারের কথাটা কানে বাজে, শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেম হলো সর্বোত্তমভাবে নিজের কাজ করা।
সূত্র - আনিসুল হক, দৈনিক প্রথম আলো

Wednesday, January 1, 2014

তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে - ভারত-চীন ব্রহ্মপুত্র সমঝোতা স্মারক অনুকরনীয়

ভারত-চীন ব্রহ্মপুত্র সমঝোতা স্মারক থেকে আমাদের শেখার আছে


চীন ও ভারতের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ বিষয়ে সর্বশেষ যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তাতে কি নদীর পানির ওপর তীরবর্তী ভাটির দেশের অধিকারের স্বীকৃতি মেলে? এ সমঝোতা স্মারককে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারতের পানি কূটনীতির এক বড় সাফল্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলেও পানি বিশেষজ্ঞরা সাফ বলে দিয়েছেন, ‘না তা মেলেনি’। বিগত ২৩ অক্টোবর বেইজিংয়ে এ স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আসলে এ সমঝোতা স্মারক হলো দু’দেশের মধ্যে ইতঃপূর্বে স্বাক্ষরিত চারটি দ্বিপক্ষীয় ডকুমেন্টের পরবর্তী স্তর। আগে সই করা ডকুমেন্টগুলো ছিল নি¤œরূপ : ক. গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের মধ্যে ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার কার্যবিধি; খ. চীন কর্তৃক ভারতকে লাংকোয়েন জাংবো/সুটলেজ নদীর বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য ২০১০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক; গ. চীন কর্তৃক ভারতকে ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য ২০১৩ সালের মে মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক; এবং ঘ. ২০১৩ মে মাসের গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের যৌথ ঘোষণা। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিগত ২৩ অক্টোবর সই করা সমঝোতা স্মারকের শর্তগুলো নি¤œরূপ : উভয়পক্ষ স্বীকার করে যে, আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো এবং এদের সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ নদী তীরবর্তী সব দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান অ্যাসেট। উভয়পক্ষ স্বীকার করে নেয় যে, অভিন্ন নদীগুলোর ব্যাপারে সহযোগিতা, পারস্পরিক কৌশলগত সহযোগিতা এবং যোগাযোগের আস্থা বাড়াবে এবং সাথে সাথে কৌশলগত এবং সহযোগিতার অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করবে। উভয়পক্ষ চীন ও ভারতের মধ্যকার আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার ভূমিকা এবং গুরুত্ব মেনে নেয়। ভারত পক্ষ বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদান এবং জরুরি অবস্থা ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার জন্য চীনের প্রশংসা করে। চীনা পক্ষ ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদানের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের মে মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রজাতন্ত্রী ভারতের পানি সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে নির্ধারিত জুন মাসের পরিবর্তে মে মাস থেকে প্রদান করতে সম্মত হয়। ২০১৩ সালের সমঝোতা স্মারক অনুসারে এসব তথ্য জুন মাস থেকে দেয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে ইয়ালুজাংবু/ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য চীন মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সরবরাহ করবে। উভয়পক্ষ সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি বাস্তবায়ন করবে। ভারতীয় পক্ষ এ ব্যাপারে চীনা পক্ষকে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানায়। দু’পক্ষ অভিন্ন নদী বিষয়ে সহযোগিতা আরো শক্তিশালী করার ব্যাপারে একমত হয় এবং বর্ষা মওসুমের পানি প্রবাহবিষয়ক তথ্য প্রদান, জরুরি ব্যবস্থাপনা এবং পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে মতবিনিময়ের এই সহযোগিতা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বোঝাপড়ার কাঠামোর ভিত্তিতে করতে সম্মত হয়। স্বাক্ষর প্রদানের সাথে সাথেই এই সমঝোতা স্মারক চালু হয়েছে এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে তা সংশোধন বা পরিবর্তন করা যাবে। ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা এই সমঝোতা স্মারক নিয়ে যে ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে তাকে ‘অবান্তর ও ভ্রমাত্মক’ আখ্যায়িত করলেও সাথে সাথে এ কথাও বলেছে যে, ‘এতে আশান্বিত হওয়ার একটা মজার লক্ষণ রয়েছে।’ ভারত ইউনিয়ন সরকারের সাবেক সেচ (পানিসম্পদ) সচিব, বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় পানি বিশেষজ্ঞ ও পানিকর্মী, রামাস্বামী আয়ার আরো বলেছেন- ‘বন্যা সম্পর্কিত কতক তথ্যের বিষয় বাদ দিলে নদী বিষয়ে ভারত-চীন সমঝোতা স্মারকে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।’ ভারতের পানিকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে ‘ওয়াটারওয়াচ’ গ্রুপের কাছে দেয়া এক নোটে তিনি লিখেছেন, সমঝোতা স্মারকে উল্লিখিত স্বীকৃতি- আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো এবং এদের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ নদী তীরবর্তী সব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান অ্যাসেট; কোনো দুনিয়া কাঁপানো কিছু নয়। ‘আমি মনে করি চীনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, সে নিজেকে ছাড়াও অন্য নদী তীরবর্তী দেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু এই স্বীকৃতির কারণে চীনের ওপর কোনো প্রতিশ্রুতির দায়দায়িত্ব বর্তায় না।’ রামাস্বামী আয়ারের মতে, স্মারকে উল্লেখিত ‘পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে মতবিনিময়’ বড় কিছু গুরুত্ব বহন করে না। এর মধ্যে ভারতকে (বা চীন) তার স্বার্থবিষয়ক কিছু উত্থাপন করতে বারণ করার মতো কিছু নেই এবং কোনো পক্ষ কোনো বিষয় উত্থাপন করলে, অন্য পক্ষকে তার জবাবে কিছু বলতে হবে। এটুকু কাজের জন্য সমঝোতা স্মারকের দরকার হয় না। তার মতে, ‘মতবিনিময়ের’ অর্থ মতৈক্যে পৌঁছানো বোঝায় না। মতের বিভিন্নতা ও বিনিময় হতে পারে। ভারত বলতে পারে, ‘আমরা তোমাদের প্রকল্পগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন’ এবং চীন উত্তরে ‘এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ বলে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এটাও হবে মতবিনিময়! ভারতের এই সাবেক সেচ সচিব তার বক্তব্যের সমাপ্তি টেনেছেন আরো তীè ভাষায়। ‘আমি অবাক হয়ে যাই যে এই সমঝোতা স্মারককেও ‘বড় সাফল্য’ বা ‘দিগন্ত উন্মোচন’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এজন্য দরকার ছিল প্রকল্প পরিকল্পনা (বিস্তারিত টেকনিক্যাল ব্যাখ্যাসহ) ভারতকে পূর্বাহ্নে অবগত রাখা এবং তা নিয়ে পরামর্শ করার প্রতিজ্ঞা, যেন ভারতের উৎকণ্ঠা যথাযথভাবে বিবেচিত হয় এবং ভারতের ক্ষতি হয় এমন কিছু না করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আমি এর কিছুই দেখছি না। কাজেই কেউ কি এমন মতপোষণ করতে পারে, অভিন্ন নদীর ব্যাপারে সহযোগিতার এই একাত্মতা এ ধরনের কিছু অর্থবহন করে? আমি এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করি।’ ভারত ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের জন্য বিশাল গুরুত্ব বহন করে এবং এ জন্য তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল দিয়ে নেমে আসা নদীগুলোর সর্বশেষ ভাটির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং উজানে অবস্থিত দেশগুলোর (চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটান) নদী বিষয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর পড়তে বাধ্য। নদীগুলোর প্রবাহ বাংলাদেশের ওপর দিয়েই সাগরে গিয়ে পড়ে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রামাস্বামী আয়ারের উল্লিখিত শর্তগুলোর কোনটিই আমাদের সর্ববৃহৎ বা বলতে গেলে একমাত্র নিকট প্রতিবেশী ভারতের সাথে পানি কূটনীতিতে নেই। ৩০ বছরের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিতে এই নদীর উজানে প্রকল্প পরিকল্পনা (বিস্তারিত টেকনিক্যাল ব্যাখ্যাসহ) বাংলাদেশকে পূর্বাহ্নে অবগত রাখা, তা নিয়ে পরামর্শ করার প্রতিজ্ঞা এবং বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা যথাযথভাবে বিবেচনা করার কোনো বিধান বা প্রতিশ্রুতি নেই। নদীর উজানে প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের বক্তব্য প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। ফারাক্কা পয়েন্টে ভাগাভাগির জন্য যেন বাংলাদেশের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ বজায় থাকে তা নিশ্চিত করার কোনো বাধ্যবাধকতা প্রতিবেশী ভারতের নেই। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকার কর্মরত থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, যারা ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পানি না পাওয়ার ব্যাপারে আওয়াজ তুলছেন তারা পানি বণ্টন চুক্তিটাই বোঝেন না। ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণে পানি এলেই তো বণ্টনে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, কিছুকাল যাবত হিমালয়ের বরফ যথেষ্ট পরিমাণে না গলায় গঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহ ফারাক্কা পর্যন্ত যথেষ্ট ছিল না। তার এ বক্তব্য ঢাকার পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের পানির হিস্যা ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত প্রবাহের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল, এ কথায় অর্থ দাঁড়ায়, ফারাক্কায় পানির প্রাপ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোনো পথ বাংলাদেশের নেই। উজানে কী প্রকল্প নেয়া বা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এ ধরনের কোনো তথ্য বাংলাদেশকে জানাবার ব্যবস্থা অনুপস্থিত এবং সেসব প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা জানাবার কোনো উল্লেখ চুক্তিতে নেই। অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির শর্ত নিয়ে টানাপড়েনে। তিস্তা নদীর উজানে ইতোমধ্যেই বহু পানি প্রত্যাহারের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতের একমাত্র সিকিম রাজ্যেই এ ধরনের অন্তত ছয়টি পানি-স্থাপনা আছে। সেখান থেকে পাহাড়ি সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের খ্যাতনামা পানিকর্মী ও লেখক অঞ্জল প্রকাশ সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক কর্মশালায় বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কী পরিমাণ পানি বাংলাদেশে প্রবাহ হবে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ব্যবস্থাপনায় তীরবর্তী দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ ও পানি-কর্মীদের মধ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দুই দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা এখনো তিস্তার বাংলাদেশ অংশে কী পরিমাণ পানি পাওয়া যাবে সে বিষয়ে অনুমানভিত্তিক শতাংশের হিসাবের ওপর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। উজানে যেসব পানি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে আশঙ্কা থাকলে তা ব্যক্ত না করে এবং আশঙ্কা নিরসনের কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া ছাড়াই আলোচনা চলছে। উজানে প্রত্যাহের পর তিস্তার অবশিষ্ট পানি দিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন মিটবে কিনা বা তা তিস্তা নদীকে জীবন্ত রাখার জন্য যথেষ্ট হবে কিনা, এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হচ্ছে না। এই ধারণার সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে ভারতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ নিয়ে আলোচনায়। এ ড্যামের ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে ওই স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে ভারত কর্তৃক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাস্তবায়নের পর্যায়ে পৌঁছাবার পর। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অভিন্ন নদীর ওপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ড্যাম নির্মাণের কী বিরূপ পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিপর্যয় বরাক (মেঘনা) নদীর নি¤œাঞ্চল বাংলাদেশ হতে পারে তা নিরূপণ এতদিন করা হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার পরিবেশগত প্রভাবের ওপর কাজ করছে। ভারতের তরফে বলা হয়েছে, এই ড্যাম থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের অংশ বাংলাদেশকে দেয়া হবে। এ জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে আহ্বান করা হয়েছে। বাংলাদেশের পানি কূটনীতি এখনো এ দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের সাথে সাযুজ্য রেখে সাজানো হয়নি। বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা এখনো তাদের কথাবার্তায় এটা প্রতিফলিত করতে পারছেন না যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই অবদান। এখানকার জীবনজীবিকা নদীপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রাকৃতিক প্রবাহগুলোর ওপর ভারসাম্যহীন হস্তক্ষেপ তাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং এসবের ওপর নির্ভরশীল জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির বাংলাদেশ জনগোষ্ঠী এক কঠিন বিপাকে পড়বে। নদ-নদীগুলো যদি মনে যায় বা এগুলোকে শুধু বর্তমানের প্রয়োজনে হত্যা করা হয় এবং এর ফলে বাংলাদেশে জীবনজীবিকা বাধাগ্রস্ত হয়, তার প্রতিক্রিয়া পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বা দেশে পড়তে বাধ্য। এ কারণে যদি বাংলাদেশে পরিবেশ সৃষ্ট বাস্তুহারার সংখ্যা বেড়ে যায়, তাদের বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া যতই উঁচু হোক না কেন এভাবে সৃষ্ট বাস্তুহারাদের বাঁধভাঙা ঢল কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিষয়টা ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের কাছে দিবাগুলোকের মতো পরিষ্কার। কিন্তু এ বিষয়ের গভীরতা সেখানকার নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরও উপলব্ধিতে এখনো আনা যায়নি। বাংলাদেশের তরফ থেকেও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই প্রেক্ষিতে অক্টোবরে স্বাক্ষরিত ভারত-চীন সমঝোতা স্মারক খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই সমঝোতা স্মারকের শর্ত পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের পানি আলোচকেরা দুই প্রতিবেশী বন্ধু দেশের মধ্যে অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথার্থ অবস্থান নিতে সহায়তা পাবেন। সর্বশেষ এই স্মারক সই করার আগে ভাটির দেশ ভারত উজানের দেশ চীনের সাথে চার-চারটি ডকুমেন্ট স্বাক্ষর করেছিল। প্রত্যেকটি পূর্বেরটির চেয়ে উন্নততর। এখনো ব্রহ্মপুত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী চুক্তি হয়নি। তবে বর্তমান স্মারক ভবিষ্যতে একটি টেকসই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই স্মারক সুযোগ এনে দিয়েছে ভারতের সাথে আমাদের অবস্থানের পর্যালোচনা করার। কিভাবে ভাটির দেশ হয়েও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী উজানের দেশের সাথে বোঝাপড়া করে এগোনো যায়। শক্তির ভারসাম্যে অসম অবস্থানে থেকেও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তবে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর তীরবর্তী সব দেশের এ কথা উপলব্ধি করা উচিত যে, প্রকৃতির নদীগুলোকে ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে শাসন করা হবে এগুলোকে হত্যা করার শামিল। নদীগুলো তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে সাগর পর্যন্ত জীবন্ত না থাকলে এদের সেবাও পাওয়া যাবে না। ভারসাম্যহীন পানি প্রত্যাহারের ফলে জীবনীশক্তি কমার সাথে সাথে নদীগুলো তাদের সেবা দেয়ার ক্ষমতা হারাতে থাকবে এবং এক সময় মরে যাবে। বিপন্ন হবে পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীবন, জীবিকা এবং জনপদ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থা কেমন ভয়াবহ হবে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা দরকার। তার জন্য বিদেশ যেতে হবে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে গঙ্গানির্ভরশীল এলাকায় কী ঘটেছে তা সেখানকার জনগণকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। এই অঞ্চলে দুই ডজনের বেশি নদী বিগত চার দশকে মরে গেছে।
সূত্র- নয়াদিগন্ত,  লেখক : সম্পাদক, দৈনিক গ্রিনওয়াচ, ঢাকা।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ - বিদেশী হায়েনা ও দেশীয় সিন্ডিকেটের কবলে

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সিন্ডিকেটের কবলে

 বাংলাদেশের ভূ-অভ্যšত্মরের সমতলে ও সমুদ্রবক্ষের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, বিপণনসহ কর্তৃত্ত্বের ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বব্যাপী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বহুজাতিক ও মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করার কূট চাল চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও মার্কিন কূটনৈতিকরা পৃথিবীর দেশে দেশে অবস্থান করে দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে।



বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে বিদেশি কোম্পানিগুলো করাল থাবা বসিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের আšত্মর্জাতিক দরপত্র আহবান করে বাংলাদেশ, এই দরপত্র আহবান করার পর আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো শর্তের অজুহাতে দরপত্রে অংশগ্রহণ করেনি এবং এশীয় অঞ্চলের অন্য কোন কোম্পানি যাতে অংশগ্রহণ না করে এই জন্যও তারা গোপন তৎপরতা চালায় বলে শোনা গেছে। তাই বাংলাদেশের আহবানকৃত দরপত্রে কোন কোম্পানি অংশ নেয়নি। ফলে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কোন আšত্মর্জাতিক কোম্পানিকে কাজে লাগাতে পারেনি। আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ সরকারকে দরপত্রের শর্ত শিথিল করার আহবান জানায়। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নেতৃত্ত্ব সরকারের কাছে আবেদন জানায় যে, আহরিত তেল-গ্যাস তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে এমন শর্ত আরোপ করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের জন্য। বাংলাদেশ সরকার যদি আšত্মর্জাতিক কোম্পানির এই আবদার মেনে পুনরায় দরপত্র আহবান করে তাহলে বাংলাদেশকে গাধার মতো মিঠাইয়ের বোঝাই বহন করা হবে মিঠাইয়ের স্বাদ আর গ্রহণ করতে পারবে না। বিশেষ করে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানি চাইছে বাংলাদেশের সমুদ্রগভীরে রক্ষিত গ্যাসের একচ্ছত্র আধিপত্য। তা যদি না হতো তাহলে তারা কিভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির শর্ত উল্লেখ করে পুনরায় বাংলাদেশকে দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানায়।

এদিকে বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটে ভুগছে। লোডশেডিংয়ে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই বা¯ত্মবতায় বাংলাদেশের জ্বালানিসম্পদ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার শর্ত কিভাবে সরকার গ্রহণ করবে? আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্র¯ত্মাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার সংশোধিত উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এই নমনীয়তার কারণে সমতলের গ্যাস আহরণকারী আšত্মর্জাতিক মার্কিন কোম্পানি শেভরণ দেশের অন্যতম গ্যাস ক্ষেত্র বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজারের গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কিছু শর্ত শিথিল করার জন্য পেট্রোবাংলাকে চাপ দিচ্ছে। জানা গেছে পিএসসিতে গ্যাসের দাম কম ধরায় ও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করার কথা উল্লেখ না থাকায় তাদের এই আপত্তি। আšত্মর্জাতিক কোম্পানি এই দেশের গ্যাস নিয়ে যে বাণিজ্য করছে তা দেখে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির আহরিত গ্যাস সরকার যে দামে কিনে তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি দামে সরকারকে গ্যাস কিনতে হয় আšত্মর্জাতিক কোম্পানির আহরিত গ্যাস অথচ উভয় কোম্পানি বাংলাদেশের ভূগর্ভ থেকে গ্যাস আহরণ করে। আমরা যে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় গ্যাস পাই এই গ্যাস পেট্রোবাংলা বাপেক্সের কাছ থেকে কিনে প্রতি হাজার ঘনফুট ৭ টাকা করে আর আšত্মর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কিনে প্রতিহাজার ঘনফুট ৩ ডলার করে। উপরš‘ আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। আমাদের দেশে তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে আর তাদের ট্যাক্স আমাদেরকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে তাছাড়া আšত্মর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করা গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারের মাধ্যমে ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ পড়ে। নিয়তির কি পরিহাস আমাদের দেশের সম্পদ আমাদের রিজার্ভ ব্যয় করে বিদেশ থেকে আমদানি করা দ্রব্যের মতো আমাদেরকেই কিনতে হচ্ছে। আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারকে প্রতি বছর ২০০০ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিষয়টা অনেকটা নিজভূমে পরবাসের মতো। বাংলাদেশ থেকে ৩০ গুণ বেশি দাম নেয়ার পর আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলোর তৃপ্তি হচ্ছে না তাদের আরও চাই, বর্তমানে আšত্মর্জাতিক কোম্পানিগুলো চাইছে আহরণ করা সম্পূর্ণ গ্যাস পা¯ত্মুরিত করে তারা যেন তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারে সরকার যেন তাদের এই অনুমোদনটাই দেয়। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নেতৃত্ত্ব আšত্মর্জাতিক কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করে আবেদন করেছেন যে, সমুদ্রপৃষ্ঠে তাদের আহরিত গ্যাসের দাম বাড়াতে এবং কোম্পানির অংশের গ্যাস বাজার দর অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে। যেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না, তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক উৎপাদন কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে তাছাড়া গ্যাস সংকটে দেশের চাহিদা অনুযায়ী ইউরিয়া উৎপাদন কমে গেছে। চাহিদার প্রায় একদশমাংশ ইউরিয়া বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে। এ খাতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেভরনের এই প্র¯ত্মাব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? বাজার দর অনুসারে গ্যাস বিক্রি করলে কেন তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে হবে? কেন বাংলাদেশের কাছে নয়? কেন মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ থেকে গ্যাস আহরণ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করতে চায় না কেন? পেট্রোবাংলাকে কি শেভরন জিম্মি করে ফেলেছে? শেভরনের আচরণ দেখে মনে হয় মার্কিন এই কোম্পানিটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানার শিকড় প্রোথিত করে বসে আছে। আর এই কোম্পানিটির প্রভাবে এশীয় অঞ্চলের কোন কোম্পানি দরপত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের গভীরসমুদ্রের তেল-গ্যাস আহরণের দরপত্রে মার্কিন কোম্পানি শেভরন চাচ্ছে সমুদ্রের আহরিত গ্যাস তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার অধিকার। অথচ বাংলাদেশের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের ৫০ বছরের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে (যদি শতকরা ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়) তাহলে দরকার প্রায় ১১০ টিসিএফ গ্যাস। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমানে আছে ৭-৮ টিসিএফ। আমরা কয়লাকে যদি এই হিসাবের আওতায় এনে হিসাব করি তাহলে হবে ৩৫-৪০ টিসিএফ যদিও কয়লা নিয়ে এশিয়া এনার্জিও কুচাল অব্যাহত রয়েছে। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, আরও প্রয়োজন ৬০-৭০ টিসিএফ গ্যাস বর্তমানে যে গ্যাস মজুদ আছে তা থেকে প্রায় ১০ গুণ গ্যাসের প্রয়োজন হবে। এই গ্যাসের জন্য বাংলাদেশকে পুরোপুরি বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এর ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের আহরিত গ্যাস কোন ক্রমেই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা যাবে না। যদি সংশোধিত পিএসসিতে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করার এমন ধারা সংযোজন করা হয় তা হবে দেশের জন্য আত্মঘাতী। শেভরনসহ বিদেশি কোম্পানিগুলো চাইবে আšত্মর্জাতিক বাজারে গ্যাস বিক্রি করতে। কারণ এখানে তাদের দুই ধরনের লাভ নিহিত আছে এক অধিক মুনাফা অজর্ন দুই আধিপত্য বি¯ত্মার। বাংলাদেশ যদি বিদেশি কোম্পানির সিন্ডিকেটে প্র¯ত্মাবিত ধারাগুলো পিএসসিতে সংযোজন করে তাহলে এই দেশও নাইজেরিয়ার রূপ লাভ করবে। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানির সিন্ডিকেটে ঘেরাটোপে বাংলাদেশ ক্রমশই জড়িয়ে পড়ছে আর এর ফলে এই বিদেশি কোম্পানিগুলো আšত্মর্জাতিক দরপত্রে মনোপলি আচরণ করেই যাচ্ছে। তাছাড়া মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কূটনৈতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকা-ের নিয়ামকের স্থান দখল করে নেয়ায় সরকারি ও প্রধান বিরোধীদল তাদের তোষামোদ করে এবং তাদের দিক নির্দেশনা মেনে রাজনীতি পরিচালনা করে। দেশের রাজনৈতিক অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে এই কূটনৈতিকরা হ¯ত্মক্ষেপ করে থাকে। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে কোটি কোটি টাকার মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানায় বিদেশি কোম্পানিরা ভাগ বসাতে শুর“ করে জোট- মহাজোটের আমল থেকে, ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে প্রথম শুর“ হয় গ্যাস ক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া, বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোকে বিভিন্ন বস্নকে ভাগ করে বিভক্ত করা হয়েছে। আর বিএনপি সরকার সেই সময় ১৫, ১৬নং বস্নক কেয়ার্ন এনার্জি-হল্যান্ড সি-সার্চকে। বস্নক ১২, ১৩ ও ১৪ অক্সিডেন্টালকে। বস্নক ১৭, ১৮ অকল্যান্ড রেক্সউডকে। বস্নক ২২ ইউনাইটেড মেরিডিয়ান করপোরেশনকে ইজারা দিয়ে দেয়। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সেই ধারা অব্যাহত রাখে। আওয়ামী লীগ সরকার এখানে ব্যতিক্রম হিসেবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে নামমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে সংযোজিত করে। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার বস্নক ৫, ১০ শেল-কেয়ার্ন এনার্জি- বাপেক্সকে, বস্নক ৯ টাল্লো-শেভরন-টেক্সকো-বাপেক্সকে, বস্নক ৭ ইউনিকল বাপেক্সকে ইজারা দেয়।

এভাবেই বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে কর্তৃত্ব করতে শুর“ করে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্স ত্রিমাত্রার ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির পরিত্যক্ত করে রাখা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কারের মতো অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। কুমিল্লার শ্রীকাইলসহ দেশের অনেক স্থানে গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর মেধাকে কেন সরকার কাজে না লাগিয়ে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর হচ্ছে তা কিš‘ জনমনে প্রশ্ন নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতির জোগান দিতে পারলে তারা বিদেশিদের চাইতে বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হবে। তাই সরকারের উচিত বিদেশিদের ঘেরাটোপের সিন্ডিকেট কবল থেকে দেশের প্রাকৃতিকসম্পদকে রক্ষা করা। তা করার জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সমুদ্রবক্ষের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের কাজে লাগাতে হবে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের যে রিজার্ভের বিনিময়ে দেশের গ্যাস বিদেশিদের কাছ থেকে কিনতে হয় সেই বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
সূত্র - শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : দৈনিক আমাদের সময় ।

2013 সাল - দুর্নীতির ছোবলে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো

2013 সাল - দুর্নীতির ছোবলে বিধ্বস্ত  বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো


কার্টুন: তুলিসুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের জন্য ২০১৩ সালটি ছিল বিনষ্ট সম্ভাবনার এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। জনগণ, যারা দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দেখতে চায়, তাদের জন্য বছরটি ছিল উদ্বেগজনক, আর সরকারের জন্য আত্মঘাতী। দুর্নীতির অভিযোগকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অস্বীকার করার প্রবণতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাকে পদদলিত করেছে। দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। নীতি ও শাসনকাঠামোতে দুর্নীতি-সহায়ক শক্তির প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে। বছরের শেষে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীদের প্রশ্নবিদ্ধ সম্পদ আহরণের নগ্ন চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার ফলে পর্বতসম মুনাফা এবং সম্পদ আহরণের এই সুযোগ যে বাস্তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের ক্ষমতার লড়াইয়ের মূল প্রণোদনা, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়েছে। সর্বোপরি রাষ্ট্রক্ষমতা একধরনের চৌর্যোন্মাদনার করাভূত হতে চলেছে।
নবম সংসদ নির্বাচনে মহাজোট সরকারের বিপুল জনসমর্থন অর্জনে যে কয়েকটি উপাদান শীর্ষ ভূমিকায় ছিল, তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি প্রতিরোধের অঙ্গীকার। শুরুটা মন্দ ছিল না। অষ্টম সংসদে যেখানে সংসদীয় কমিটি গঠনে প্রায় দেড় বছর পার করা হয়েছিল, নবম সংসদে সে তুলনায় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সব কটি কমিটি গঠিত হয়। অনেক কমিটি মোটামুটি নিয়মিত সভা করেছে, যদিও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে কমিটিগুলো অকার্যকরই রয়ে গেছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। পঞ্চম সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল প্রথমবারের মতো এই বর্জনের সংস্কৃতি চালু করে অধিবেশনের প্রায় ৩৫ শতাংশ কার্যকাল অনুপস্থিত থেকেছিল। এর পর থেকে বজর্েনর হার নির্লজ্জভাবে বাড়তে থাকে, যা নবম সংসদের বিরোধী জোটের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়।
সংসদের প্রথম অধিবেশনে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ পাস হয়। পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রকাশ সুরক্ষা আইন, ২০১১ গৃহীত হয়। একইভাবে ইতিবাচক ছিল সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রশিক্ষণ, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ প্রণয়ন, স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর তথ্যসেবা কেন্দ্র সম্প্রসারণ, সীমাবদ্ধভাবে হলেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ই-প্রকিউরমেন্ট ইত্যাদি।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে প্রদত্ত অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের সংস্কার করা হয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশ সম্প্রতি অ্যাগমন্ট গ্রুপের সদস্য হতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার করা অর্থের ফেরত আসার মাধ্যমে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল গৃহীত হয়েছে, যা জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
তবে এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ দুর্নীতি প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারেনি। কারণ, সরকারের পুরো মেয়াদেই জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং আইনের শাসনের মৌলিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থার ওপর নির্বাহী ও রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের মেয়াদের শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী অঙ্গীকারকে পদদলিত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে একটি অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ধারা সংযুক্ত করে সরকারি কর্মকর্তা, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণে দুদকের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হয়রানিমূলক বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া এরূপ পূর্বানুমতিপ্রাপ্তি যে অকল্পনীয়, তা জেনেই এটি করা হয়েছে বলে ধারণা করা অযৌক্তিক নয়। দুদককে শক্তিশালী ও কার্যকর করা হবে, এরূপ সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসে এ ধারাটিসহ একগুচ্ছ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে দুদককে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখা হয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকটা সরকারের বি-টিমে পরিণত হতে দেখা যায়। সবশেষে আইনটির ওপর রাষ্ট্রপতির সম্মতি আদায় করে সরকার প্রমাণ করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার নির্বাচনী অঙ্গীকার ফাঁকা বুলি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের ০-১০০ স্কেলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ২৭ পয়েন্ট পেয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় অনেক কম। তদুপরি বিব্রতকরভাবে বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব বেড়েই চলেছে। ডিসেম্বর ২০১২ সালে প্রকাশিত টিআইবি পরিচালিত মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক জাতীয় খানা জরিপ ২০১২-এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেবা খাতে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করা ঘুষের মোট প্রাক্কলিত অর্থের পরিমাণ জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৪ ও জাতীয় বাজেটের ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০১০ সালে যথাক্রমে ১ দশমিক ৪ ও ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। খানাপ্রতি সার্বিকভাবে মোট বার্ষিক ব্যয়ের ৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঘুষ বাবদ ব্যয়িত হয়েছে। উচ্চতর আয়ের খানার ক্ষেত্রে ঘুষ বাবদ ব্যয়ের হার যেখানে ১ দশমিক ৩ শতাংশ, নিম্নতর আয়ের বেলায় সেটি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ দুর্নীতির বোঝা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই বেশি বইতে হয়।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত বিশেষায়িত নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রমেও অনিয়ম প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের সর্বনিম্ন থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা অংশীজনের ভূমিকায় থেকে লাভবান হয়েছেন। সরকারি খাতে চাকরিপ্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায় দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বা অবৈধ অর্থ প্রদানের সামর্থ্যই নিয়োগপ্রাপ্তির উপায়, মেধা বা যোগ্যতা আর তেমন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
অন্যদিকে, ২৪ এপ্রিল ২০১৩ রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১০০ জনের বেশি নিরপরাধ শ্রমিক-কর্মীর নির্মম মৃত্যুর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, দুর্নীতির কারণে মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। রানা প্লাজা ধসের পেছনে দুর্নীতির প্রভাব ছিল দিবালোকের মতো পরিষ্কার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে বেআইনিভাবে দখল করা জমিতে অবৈধ প্রক্রিয়ায় আইন ও বিধিমালা অমান্য করে নির্মিত ভবনে অবৈধভাবে পরিচালিত পোশাক কারখানায় ঝুঁকি চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও কাজে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে ত্বরিত মুনাফার লোভে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিটি স্তরে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার।
দুর্নীতির কারণে প্রাণহানির আরও দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে টেন্ডারবাজি, জমি-জলাশয় দখল, বাজার, সেতু ইত্যাদির ইজারাকে কেন্দ্র করে সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সহিংস কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এক বগুড়া জেলাতেই এরূপ সহিংসতায় প্রাণ হারান ৩০ জন।
ব্যাংক, বিমা, গণমাধ্যমসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে লাইসেন্স-পারমিট ও সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রাধান্য প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসার যোগসূত্র উদ্বেগজনকভাবে বাড়ার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁদের মূল পেশা ব্যবসা, তাঁদের অনুপাত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে নবম সংসদে ৬০ শতাংশে উন্নীত হওয়া যেমন উদ্বেগজনক, একইভাবে হতাশাব্যঞ্জক ছিল সংবিধান ও সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী অবস্থান নিয়ে জাতীয় বাজেটে কালোটাকা বৈধ করার অব্যাহত সুযোগ।
বছরের শেষে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রার্থী রাজনীতিবিদদের পর্বতসম সম্পদ আহরণের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার মাধ্যমে ক্ষমতার অবস্থানকে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারের নির্লজ্জ প্রবণতার প্রতিফলন ঘটেছে। অন্যদিকে বৈধ আয়ের সঙ্গে সম্ভাব্য অসামঞ্জস্যের এ চিত্র প্রকাশের কারণে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাধরদের একাংশ যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আবদার নিয়ে হাজির হন, তেমনিভাবে নির্বাচন কমিশনও এ তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দেয়, যদিও নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরে আসতে বাধ্য হয়।
নির্বাচন কমিশনের মতো দুর্নীতি দমন কমিশনও পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সম্পদ আহরণের এ প্রবণতাকে শুধু সমর্থনই করেননি, বরং বিষয়টিকে একটি সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো সাহসিকতা দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢালাওভাবে এরূপ অস্বীকৃতির আত্মঘাতী প্রবণতাই বিশ্বব্যাংকের হাতে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে একদিকে সরকারকে বিব্রত করতে এবং অন্যদিকে দেশবাসীকে স্বল্পঋণে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সর্ববৃহৎ প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করতে।
একই অস্বীকৃতির প্রবণতার কারণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে অনিয়মের ক্ষেত্রে বা শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে। ডেমু ট্রেন ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন চিহ্নিত অনিয়মের ক্ষেত্রেও সরকার কোনো দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, যেমন নির্বিকার থেকেছে প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল আকারের ক্রয়ে স্বচ্ছতার চাহিদার ক্ষেত্রে। সবকিছু ছাপিয়ে জনপ্রতিনিধি এবং অন্যভাবে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ আহরণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে বছরটি শেষ হয়েছে এবং তাকে যেভাবে পরিপোষণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তার ফলে রাষ্ট্রকাঠামো চৌর্যোন্মাদনার করাভূত হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হতে হয়।
ক্ষমতার রাজনীতির মূল উপাদান যে দুর্নীতি, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্ষমতায় থাকায় লাভবান হওয়ার সুযোগ যেমন পর্বতসম, ক্ষমতায় না থাকলে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি জেল-জুলুমসহ বহুবিধ হয়রানি এমনকি গুম-হত্যার ঝুঁকিও ক্রমাগত বেড়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা শুধু আর্থসামাজিক উন্নয়নকেই ব্যাহত করছে না, রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার ব্যাপকতর বিস্তার ঘটিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করার ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে।
  ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সূত্র - দৈনিক প্রথম আলো