সত্য জানি, সত্য মানি এবং সত্যের সাথে থাকি। সকল খবর হোক সত্য ও নিরপেক্ষ।

সত্যকে অস্বীকার কারনে, গত চার দশকে জাতি হিসাবে আমরা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারিনি । স্বাধীনতার প্রায় অধ শতাব্দীতে জাতি তার কাঙ্তিত সাফল্য পায়নি।

মোর নাম এই বলে ক্ষ্যাত হোক – আমি তোমাদেরই লোক

যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ জাতি সমৃদ্ধিলাভ করেছে - আমরা তাদের ভুলব না । তোমরা অমর হয়ে থাকবে জাতীর ভাগ্যাকাশে। আমাদের ভালবাসা ও দোয়া রইল।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষা হোক সবার জন্য উম্মুক্ত ও সহজলভ্য।

পযটন হোক – জাতীয় উন্নতির একমাত্র হাতিয়ার।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া। কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, নীলগিরি সহ হাজারো দৃষ্টি নন্দন অপার সৌন্দার্য ছড়িয়ে আছে এ জমিনে – জানি ও সমৃদ্ধ করি দেশমাতৃকাকে।

IT BD SOFT. একটি বিশ্বস্থ আইটি ট্রেনিং সেন্টার

------Pls visit http://itbdsoft.tk ------- কম্পিউটার শিক্ষা প্রসার ও বিকাশে / এছাড়াও আমরা ডোমিন- হোষ্টিং বিক্রি /আপনার সাইটের ভিজিটর বাড়ানো / সাইটিকে কে গুগল টপে আনতে আমাদের সাহায্য নিন।

Saturday, October 5, 2013

বাংলাদেশ বিমানের ঘাটে ঘাটে লুটপাট

বিমানের ঘাটে ঘাটে লুটপাট - রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে।

বড় লজ্জা লাগে - আসলে কি আমরা দেশ প্রেমিক  -  রাস্ট্রিয় বিমান ধ্বংস হলেই যেন ওরা বাঁচে।  বাংলাদেশ বিমানের ১০ বিভাগের ২৯ পর্যায়ে প্রতি মাসেই শত কোটি টাকার লুটপাট চলছে। শ্রমিক লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই এসব লুটপাটের অন্যতম হোতা। আধুনিক নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও সেসব লুটপাটের ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, এসব লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি ফি বছর লোকসানের ঘানি টানলেও বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন। বাড়ি-গাড়ি, শানশওকতের কোনো কমতি নেই তাদের। লুটপাটের টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও বণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা বরাবরই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিমানের মতিঝিল সেল্স অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, সম্ভার ও ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও ডিউটি রোস্টার শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন ও লুটপাট ঘটে থাকে। তবে বিমানের সিট রিজার্ভেশনের নামে চলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির কার্যকলাপ। সিট রিজার্ভেশন শাখায় এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিমানের ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজার্ভেশন শাখায় এই সিন্ডিকেট রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের খপ্পরে অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের নামে কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন সিস্টেম (সিআরএস) প্রোভাইডারকে ১৪০ কোটি টাকা বিল পরিশোধে বাধ্য হয়েছে বিমান। সরকারি অডিটেও এ বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ওই অডিটে বলা হয়েছে, যদি সিন্ডিকেট না থাকত তাহলে রিজার্ভেশন প্রোভাইডারের সর্বোচ্চ বিল হতো মাত্র ৬ কোটি টাকা। সম্ভার ও ক্রয় বিভাগে যে কোনো ধরনের মালামাল আসামাত্র সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে কমিশন দিতে হচ্ছে। এ খাত থেকে সিবিএসহ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘাটে ঘাটে শুধু মাসহারা আর চাঁদাবাজিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, লাগামহীন দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে বিমানে। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালনা, লোকবল নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন লুটপাট। কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য, কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইন্স যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমানকে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এ নিয়ে টানা তিন বছর লোকসান দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, সব মিলিয়ে ৬ বছরে জমা হওয়া ৯৬২টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এসব অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬৮ টাকা। এদিকে, বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের দায়ে প্রায় ৩৫০টি মামলা রয়েছে বিমানের বিরুদ্ধে। এত মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। আবার এসব মামলা চালানোর নামে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
ওভারটাইমে লুটপাট : রোস্টার তৈরিতে চাঁদাবাজি : শ্রমিক-কর্মচারীদের ওভারটাইমের নামে আরেক হরিলুটের মচ্ছব চলছে বাংলাদেশ বিমানে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওভারটাইম খাতে বিমানকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। আগের বছরও এর পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। শিফটিং ডিউটি চালু করায় এ ক্ষতি চলতি বছর ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। জানা গেছে, যানবাহন শাখায় কর্মরত একজন ড্রাইভার প্রতি মাসে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজারের চেয়েও বেশি বেতন পকেটস্থ করছেন। ওভারটাইমের অজুহাতে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। একজন ড্রাইভার দিনে ২-৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পাচ্ছেন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে বিমানে কর্মরত সর্বনিম্ন স্কেলধারী (গ্রুপ-৩-১) একজন লোডারের বেতন স্কেল হচ্ছে ১৪ হাজার ২৫০ টাকা, অথচ মাসে ওভারটাইম ও বিভিন্ন ভাতাসহ তিনি বেতন উঠাচ্ছেন ৫৪ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৭০ টাকার স্কেলধারী (গ্রুপ-৫) শ্রমিক (সুপারভাইজার) মাসে বেতন তুলে নিচ্ছেন ১ লাখ ২ হাজার টাকা। এসবই সম্ভব হচ্ছে শুধু ওভারটাইম বিলের কল্যাণে। ওভারটাইমের নামে বিমানের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও এর বড় একটি অংশ যায় শ্রমিক নেতাদেরই পকেটে। বিমান কর্তৃপক্ষ ঢালাওভাবে চলা এই ওভারটাইম প্রথা বন্ধ করতে একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ওভারটাইম যথাসময়ে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে নতুন এমডি কেভিন স্টিল বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) চালু করেন। কিন্তু কতিপয় শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে একদল দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বিমানের গেটে গেটে স্থাপিত বেশ কয়েকটি বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) ভাঙচুর ও বিকল করে দিয়েছে। কারণ এটা থাকলে তাদের লুটপাট ও ওভারটাইম জালিয়াতি সম্ভব হবে না। সংস্থার বিভিন্ন দফতরে স্থাপিত ৩০টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটি মেশিনে সুপার গ্লু ঢুকিয়ে অকার্যকর করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা বা অতিরিক্ত ডিউটি করাসংক্রান্ত কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে চাঁদাবাজ চক্রটি পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে।
বিমানের কার্গো বিভাগের রপ্তানি শাখার স্পেস কন্ট্রোল, কার্গো ওজন চেকিং, কার্গো আমদানি শাখার মেইন ওয়্যার হাউস, ডেলিভারি গেট ও কার্গো প্রসিডিউস শাখায় শ্রমিকদের ডিউটি রোস্টারের নামে প্রতিদিন গড়ে ৮ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। শ্রমিক লীগের সিবিএ নেতারা এসব শাখায় নিজদের নামে ডিউটি নিয়ে সে কাজ সাধারণ শ্রমিকদের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেন। বিমানের এয়ারপোর্ট ট্রাফিক শাখার পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটে (পিসিইউ) পোস্টিং নিতে হলে প্রত্যেক স্টাফকে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই ইউনিটে পোস্টিং নিয়ে বিমানের একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৫-৭ হাজার টাকা পকেটস্থ করতে পারেন। চোরাচালানের সংস্পর্শে গেলে এর পরিমাণ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। যে কারণে বিমানের ট্রাফিক বিভাগের অধিকাংশ সদস্যের ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
বিমানের চেকিং কাউন্টারে বিভিন্ন ফ্লাইটে গমনকারী যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগেজ মাশুল আদায়ের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কর্মীরা। বাস্তবে এই টাকা বিমানের কোষাগারেও জমা হচ্ছে না। একইভাবে হারানো ও প্রাপ্তি শাখায় নিজদের কর্মী পোস্টিং দিয়ে ব্যাগ-ব্যাগেজ পুরোটাই গায়েব করে দিচ্ছে। বিমানের বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটে খাবার পরিবেশনের নামেই প্রতি বছর গড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, একদিকে বিমান যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মানহীন-রুচিহীন আর অস্বাস্থ্যকর খাবার, অন্যদিকে অতিরিক্ত খাবারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। বিমানের বিএফসিসির খাবার নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে। খাবারের মান খারাপ থাকায় প্রধানমন্ত্রী আবুধাবি যাওয়ার সময় বিমানের দেওয়া খাবার পর্যন্ত খাননি। ওই ফ্লাইটের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক রিপোর্টে বলেছেন, ওই ফ্লাইটের ভিভিআইপির জন্য বিএফসিসির দেওয়া আলু-পরোটা ছিল খাবারের অনুপযুক্ত। পরোটাগুলো এতটাই শক্ত ছিল যে সেগুলো খাবারের উপযুক্ত ছিল না। নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণ করতে চান না, এমনকি বাংলাদেশিরাও নন।
সর্বত্র চাঁদাবাজি-মাসহারা : বিমানের প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘাটে ঘাটে মাসহারা দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগের জন্য ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে সিবিএকে। প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ কারণে সম্প্রতি এক নিয়োগে কমপক্ষে ১০ জন জামায়াতে ইসলামীর রোকন, শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি, অর্থ সম্পাদকসহ দুটি হত্যা মামলার আসামি একজন এয়ার হোস্টেজ নিয়োগ পেয়ে যান বিমানে। বিদেশে পোস্টিং দিয়েও প্রভাবশালী চক্রটি প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি পকেটে ঢোকাচ্ছে। বিমানের ভাড়া গাড়ির ঠিকাদার ও মালিকদের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এ কাজে সিবিএকে সহযোগিতা করছেন বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ভোয়া) একজন শীর্ষ নেতা। তার তত্ত্বাবধানে সিবিএ নামধারী গাড়ির চালকরা এই চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। শুধু বেশি দামে ভাড়া নয়, গাড়িগুলোর জন্য আনলিমিটেড জ্বালানি দিচ্ছে বিমান। এই জ্বালানি তেল কেনার নামেও কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিমানের নয়া এমডি, সিইও জন কেভিন স্টিল জানান, তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংঘটিত ঘটনাবলি এরই মধ্যে দুদক তদন্ত করে দেখছে। বর্তমানে সব কটি খাতে অপচয় ও দুর্নীতি রোধে কঠোর তদারকি চলছে। পরিস্থিতি অল্প সময়েই পাল্টে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জন কেভিন স্টিল।

সূত্র -  সাঈদুর রহমান রিমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন.

Wednesday, October 2, 2013

এরশাদের নতুন ফর্মুলা - নির্বাচন পদ্ধতি

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এরশাদের নতুন ফর্মুলা
 ভোটে কালো টাকার ছড়াছড়ি আর মাস্তানির দৌরাত্ম্য কমানো, পরীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের এমপি নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’ নিয়ে নতুন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর ফর্মুলা অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পাওয়া ভোটের অনুপাতে সংসদে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে এরশাদ বলেন, এতে কোনো দলের একক কোনো আধিপত্য থাকবে না; সংসদ একদলীয় হবে না। কালো টাকার ছড়াছড়ি হবে না। কেউ অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী ও মস্তানদের প্রার্থী করে ইমেজ নষ্ট করবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কোয়ালিশন সরকার গঠন করা যাবে। আবার যে দল সরকার গঠন করুক একক আধিপত্য বিস্তার করে বিরোধী দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারবে না। 
এরশাদ প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি এ রকম : জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা হবে ৩০০। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সামর্থ অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে তালিকা পেশ করবে। তালিকার সাথে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা থাকবে। এক ব্যক্তির নাম একাধিক দলের প্রার্থী তালিকায় থাকলে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। প্রত্যেক দল নির্ধারিত কোটা অনুসারে প্রার্থী তালিকা তৈরী করবে। তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্ব কোটা তুলে ধরেন। তার মতে সাধারণ প্রার্থী হবেন শতকরা ৫০ জন। মহিলা শতকরা ৩০, সংখ্যালঘু শতকরা ১০ এবং পেশাজীবীদের শতকরা ১০ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাধারণ প্রার্থী কোটায় যে কোনো প্রার্থী থাকতে পারবেন। পেশাজীবী কোটায় থাকবেন শিক্ষক-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-শ্রমিক নেতৃত্ব। এতে সব পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব সংসদে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন দল কোন কোটায় কত আসন লাভ করবে। যে দল সর্বাধিক ভোট পাবে, সে দলই ভগ্নাংশের সুযোগ লাভ করবে। কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করলে ৩টি আসন পাবে। ১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেলে ৪টি আসন লাভ করবে। অবশিষ্ট ভগ্নাংশের যোগফলের সুবিধা সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দল ভোগ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করবেন। সে ক্ষেত্রে দলের প্রাপ্ত ভোটাধিক্য প্রথম বিবেচনা হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো দলের প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ, পদত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সংসদ সদস্য পদ হারালে ওই আসনে কোনো উপ-নির্বাচন হবে না। সংশ্লিষ্ট দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে নতুন প্রতিনিধির মনোনয়ন দেবে। নির্বাচন কমিশন তাকেই সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো দলীয় ভিত্তিতে হবে না। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এখানে সরাসরি প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। যে কোনো নির্বাচনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। 
সংবাদ সম্মেলনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানিপপের ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবর রহমান, এম এ হান্নান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, গোলাম হাবিব দুলাল, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, গোলাম কিবরিয়া টিপু, জাহাঙ্গীর মাহাম্মদ আদেল, মোস্তফা জামাল হায়দার, ফকির আশরাফ, এস এম এম আলম, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু, সাইদুর রহমান টেপা, আহসান হাবিব লিংকন, এ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম, আতিকুর রহমান আতিক, গোলাম মসিহ, মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী, এস এম মান্নান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাইদুল ইসলাম, শুনীল শুভ রায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, হাবিবুর রহমান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বাদল খন্দকার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। 
এইচ এম এরশাদ বলেন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে দলীয় শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন থাকে না। ১৯৯১ সালের সংসদে বিএনপি মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০ দশমিক ৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন আধিক্যের কারণে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। পরে জামায়াতের সেই সমর্থন সরকারের প্রতি থাকেনি। তখন আওয়ামী লীগ প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলে যায়। এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ ভোটারের রায় পাওয়া সরকার ৭০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখেও তার মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছেড়েছে। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তারা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশের রায় নিয়ে এককভাবে দেশ শাসন করেছে। আবার বিগত নির্বাচনে বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ২৯টি। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই প্রচলিত ব্যবস্থাই যে সর্বোত্তম তা নয়। এটা তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যখন দলীয় শাসন ব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও শুধু দলের ীভত্তিতে হতে পারে। ভোটাররা দলকে ভোট দেবে। সরাসরি প্রার্থীকে নয়। প্রত্যেক দল প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসনের সদস্য পাবে। তবে সদস্য পাবার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের কাস্টিং ভোটের মধ্যে ন্যূনতম ভোট পাবার সীমা থাকবে। প্রত্যেক দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থী প্যানেল তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণার মতো প্রার্থী তালিকা তৈরী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তারপর দেশে বিদ্যমান তিনশ’ আসনেই দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যে দল বেশী ভোট পাবে স্বাভাবিকভাবেই সে দল বেশী সংসদ সদস্য লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্যানেল থেকে ক্রমিক অনুসারে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করবে। যদি কোনো দল কাস্টিং ভোটের ৫০ ভাগ পেয়ে যায় তাহলে তারা ১৫০ আসন পাবে। আবার যদি কোনো দল মোট কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করে তাহলে ৩ এমপি পাবে। ওই দল তাদের প্যানেল থেকে এই ৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে দেবে। প্রাপ্ত ভোটের ভগ্নাংশের সুবিধা পাবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্য প্রার্থী প্যানেল তৈরী করে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। যে দল ভালো প্রার্থীর প্যানেল তৈরী করবে জনগণ সেই দলের দিকেই ঝুঁকবে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি করতে কোনো সন্ত্রাসী, বিতর্কিত, অরাজনৈতিক বা অযোগ্য বিত্তশালী মুর্খ প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে যাবে না। নির্বাচনী খরচ চালানোর জন্য অর্থশালীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে দলই সমালোচনার মধ্যে পড়বে। একজন সন্ত্রাসীকে প্যানেলে রাখলে গোটা দেশের নির্বাচনে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে। আর কোনো দলের ৩০০ জন প্রার্থীর প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হলেই প্যানেলভুক্ত যে কোনো প্রার্থীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে যে দল যে ক’জন সংসদ সদস্য পাবে প্যানেলের মধ্য থেকে আবার সবচেয়ে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীদেরই সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করবে। ভোটাধিক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট করে দেবে কোন এলাকা থেকে কোন দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোনো দলের আসন শুন্য হলে দলের প্যানেল থেকেই দল শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনীত করবে। 
বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশ সমূহের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল এবং সর্বশেষ জাপান ও তুরস্কে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রণিত “সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা দেশে দেশে”- গ্রন্থে উল্লেখ আছে,  “বিশ্বের ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগে সচেষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ হলো আইন প্রণয়নের জায়গা। এটা দেশ ও জনগণের জন্য কথা বলার জায়গা। আইন সভার সদস্য আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতিনিধি এক নয়। সংসদকে সবার ঊর্ধ্বে রেখে স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। আইন সভার সদস্য সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করতে পারেন। এমনকি তার কাছে জবাবদিহি করারও বিধান রাখা যেতে পারে। আইন সভার সদস্যের রিলিফের চাল-গম বরাদ্দ করার কাজে ব্যাস্ত থাকা সমীচীন নয়। এটা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির হাতে থাকাই উচিৎ। সংসদ সদস্যরা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। 
এরশাদ বলেন, প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার ব্যবস্থায় দলের পক্ষে জনগণের রায় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শুধুমাত্র সরাসরি ভোট প্রদান করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। জনগণের হাতে আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। দলীয় সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার-ডেপুটি স্পীকার-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-হুইপ নির্বাচিত হন। এমনকি নির্বাচনে জামানত হারানোর মতো প্রার্থীকেও দল মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে। জনগণ দলের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সুতরাং দল জনগণের রায় পাবার পর সংসদ সদস্য মনোনিত করে দিলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।  তিনি বলেন, দেশে এখন ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। গোটা জাতির সামনে এখন শুধু অন্ধকারই নয়- বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার একমাত্র কারণ-আগামী নির্বাচন। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়ে দেশের দুটিপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- এই দুটি পক্ষই গত ২২ বছর ধরে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন- মানুষকে শান্তি দিতে পারতেন- কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতেন- তাহলে কোনো কথা ছিলনা। বর্তমানে শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং জাতির সামনে চরম অরাজকতা অপেক্ষা করছে। কী করে এই পরিস্থিতি থেকে আমরা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারি- তার উপায় আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে।  আমি এটা প্রস্তাব দিলাম। এখন জনমত গঠন করা উচিত।
সূত্র - দৈ. ইনকিলাব।

নগ্ন হস্তক্ষেপ জনপ্রশাসনের ওপর

জনপ্রশাসনের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ

গত ২৬ সেপ্টেম্বর। সকালবেলা একটি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ও খবর দেখে ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। ছবিটিতে  রয়েছেন উত্তোলিত তর্জনী দিয়ে হুমকি প্রদানরত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং এর নিচেই তাঁর বক্তব্য—‘সরকারের কর্মকর্তারা নির্দেশ না মানলে কপালে দুঃখ আছে। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, তাঁরা সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন। সরকারের কথা অনুযায়ী তাঁদের চলতে হবে। যাঁরা নির্দেশ মানবেন না, তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

কাটুন: তুলিপ্রশাসনে এ ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ বা সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের নির্লজ্জ হুমকি প্রদানের নজির আমি আগে কখনো দেখিনি। ভাষা ব্যবহারেও এ কী দৈন্য, এ কী মানসিকতা, এ কী বিচারবুদ্ধিহীনতা! সরকারি কর্মকর্তারা কি কারও বাসার চাকর? হুকুম না মানলে ঘরে ফেরত? আর কার হুকুম? কিসের হুকুম?
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর মুখ্য সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন হয়েছে—কোন অধিকারে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারি কর্মকর্তাদের এজাতীয় কথা বলেন? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সঙ্গে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা বিস্মৃত হয়ে তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তা থেকে জনমনে এই ধারণাই জন্মাবে যে তিনি দলীয় নির্দেশকেই সরকারি নির্দেশ বলে মনে করছেন। তাঁর তো কোনো সরকারি অবস্থানই নেই। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রশাসক সম্মেলনে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ের নীতিনির্ধারক যেসব কথা বলেছেন, তাতে পরস্ফুিট হয়েছে, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কী ধরনের কার্যক্রম এবং কী প্রকারের ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ আশা করা হচ্ছে। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তেই প্রশ্ন উঠেছে—তাঁর (জনাব নাসিমের) এই বক্তব্য কি তাঁর এবং সম্ভবত তাঁর দলের অন্তর্নিহিত ভীতিসঞ্জাত, যে প্রয়োজনের সময়ে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের নির্দেশ অনুসারে চলবেন না? তিনি কি আরেকটি ‘জনতার মঞ্চের’ ভয়ে শঙ্কাকুল?
এই বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবার সরকারি দলের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
বস্তুত, এটা আজ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, অনুগ্রহ প্রদান, তোষণ-পোষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে যেনতেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করিয়ে দিতে চায়। এই বদমতলবে রেফারি হিসেবে জোগান দিতে রয়েছে একটি নির্বাচনী কমিশন, যার ওপর গণমানুষের আস্থা নেই—যাকে অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন ও আজ্ঞাবহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, সাধারণ নির্বাচনের মূল কাজ করবেন নির্বাহী কর্মকর্তারা, ডিসি বা এডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, আর প্রিসাইডিং-পোলিং কর্মকর্তা হবেন আনুগত্য-পরীক্ষিত সরকারি বা আধা সরকারি কর্মচারী, যাঁদের সরকারি দলের আদেশ অনুসারে কাজ না করলে ‘বাড়ি চলে যেতে হবে’—তাদের কপালে থাকবে দুঃখ। এই সংকটাকীর্ণ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা নিরপেক্ষ থাকবেন, এ আশা করা অসম্ভব। প্রশাসনে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, ডিসিরা বর্তমান অবস্থায় (অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায়) রিটার্নিং কর্মকর্তা হলে নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। কোনো অবস্থাতেই সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতিরেকে কোনো সাধারণ নির্বাচন সম্ভব হবে না, কেননা আমাদের নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সে জন্যই এটাই সবচেয়ে জরুরি যে সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে, তাঁদের দিয়ে সরকারদলীয় নির্দেশ পালন করানো নয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যে নির্দেশ দিলেন, তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এতে একজন নাগরিক হিসেবেই শুধু নয়, একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমি সংক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। অপমানিত বোধ করেছি। আমার বিশ্বাস, সাবেক ও বর্তমান সব সরকারি কর্মকর্তা এভাবেই বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বজনাব অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী, প্রশাসন, জ্বালানি ও অর্থ উপদেষ্টাত্রয় এবং এবংবিধ অনেকেই এই আওতায়ই পড়ছেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, দেশের প্রশাসকদের অবজ্ঞা করে, নিষ্পেষিত করে, ভয় দেখিয়ে যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিজেদের মতলব আদায় করতে চায়, তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়, তাহলে তো সারা দেশকেই পঙ্গু এবং নিষ্কর্মা করে তোলা হবে। বহু বছর ধরে ‘গণতন্ত্রে’র নামে সরকারি প্রশাসনব্যবস্থার ওপর এ ধরনের আঘাত আসছে। তাই প্রশাসনব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত—তাদের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অথচ সার্থক গণতন্ত্রের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে আস্থাভাজন, নির্দলীয় ও কর্মক্ষম প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে আমি ‘প্রশাসনের প্রহসন, না প্রহসনের প্রশাসন’—এই শীর্ষ নামে প্রথম আলোতে ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমার একটি বক্তব্য ছিল—‘আইনের শাসনের কাঠামো কয়েকটি নীতিভিত্তিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। একে একে সব স্তম্ভ যেন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণের শেষ নেই।’ ক্রম-নিম্নগামী বিবর্তন বর্তমানে প্রশাসনকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা পরম নিরাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক। সম্প্রতি একজন সাবেক উপদেষ্টা ও পুলিশপ্রধান (জনাব শাহজাহান) মন্তব্য করেছেন—‘দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই।’
উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি উদাহরণসহ বিবৃত করেছিলাম, ব্রিটিশরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক দস্যুবৃত্তি এবং পরস্বাপহরণ করলেও তারা একটি সুন্দর প্রশাসনিক কাঠামো সাবেক কলোনিগুলোতে সৃষ্টি করে গিয়েছিল, যা ফলপ্রসূ কর্মদক্ষতায়, আইননির্ভর বস্তুনিষ্ঠতায় এবং নীতিনিষ্ঠ নিরপেক্ষতায় বিভূষিত। অধ্যাপক সিরিল স্মিথের মতে, এই প্রশাসনিক উৎকর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ‘ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’—অর্থাৎ বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়া দুর্ভাগ্যবশত স্বার্থপ্রণোদিত পরিবর্তন সাধন এবং ফরমায়েশি কাটছাঁট করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং কিছুটা শ্রীলঙ্কায় প্রশাসনব্যবস্থা অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে হয়েছে এর চরম দুরবস্থা। অথচ মোগল-প্রশাসনিক ব্যবস্থার রেশ ধরে স্থাপিত কাঠামোর সুবিন্যস্তকরণ ও উৎকর্ষ সাধন করে যে ব্যবস্থা ব্রিটিশরা চালু করে গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক পরিবেশে তার বিকাশ সাধন করে প্রতিবেশী ভারত তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যথেষ্ট নির্দলীয়, মেধাভিত্তিক, আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মক্ষম করে তুলতে পেরেছে। আর আমরা বাংলাদেশে কী করেছি?
গণতন্ত্রায়ণের নামে আমরা প্রশাসনে নিয়ে এসেছি সম্পূর্ণ দলীয়করণ। ভেঙে দিয়েছি তার ঋজু ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মনোভাব ও ক্ষমতা। পদ-নিয়োগকে করেছি কোটাভিত্তিক, অনুগ্রহনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদোন্নতি ও পদায়ন হচ্ছে দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত তুষ্টিসাধনের ক্ষমতা যাচাই করে। ইদানীং তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পূর্বঘোষণা দিয়েই করা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মেধার সম্মান-প্রদান ও স্বীকৃতি নেই। তুলনামূলকভাবে তাদের আর্থিক পরিতোষণ ও নিয়মানুগতভাবে অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানও অত্যন্ত সীমিত। সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মসম্মানবোধকেও বারবার করা হচ্ছে কশাঘাত। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যদি (যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনও অন্তর্ভুক্ত) নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও কর্মক্ষম রাখা যেত, তাহলে বর্তমানে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা মোটেই হতো না। রাজনৈতিক সংকটাবস্থায় জনগণ প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে পারত।
প্রশাসনের ক্রমাবনতি, এর স্খলন ও বিচ্যুতির জন্য মুখ্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। ব্রিটিশ প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার বিধান ছিল। এমনকি ‘সরকারপক্ষের’ অনুকূলে অনৈতিক বা আইনকানুন রীতিবিহর্গিত কাজ করা ছিল অপরাধ। ভারতে এখনো এবং পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে এই ব্যবস্থাই চালু ছিল। ভাষা-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বা কারাবরণ কোনো বাঙালি চাকরিপ্রত্যাশীর নিয়োগপ্রাপ্তিতে অন্তরায় হয়নি। কিন্তু কোনো কর্মকর্তারই যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা সংসর্গ অগ্রহণযোগ্য ছিল। ভারতে বা পাকিস্তানে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কোনো আইএনএ সদস্যকে সরকারি কাজে নিযুক্তি দান করা হয়নি (যদিও তাদের অন্যবিধ সম্মান-স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল) রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে। নিয়মকানুনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করার প্রবণতাকে দমন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যের একাংশের উদ্ধৃতি দিতে চাইছি। তিনি বলেছেন, ‘অপরাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে রাষ্ট্র ও দলকে আলাদা করতে হবে। দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কোন বাংলাদেশ উপহার দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দলীয় অনুষ্ঠান হয়। তাহলে দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্য থাকে কীভাবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লোভের সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। ফ্ল্যাট, পদ, ক্ষমতার লোভে শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার—সবাই আজ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
‘শুধু রাজনীতিই নয়, দলের লেজুড়বৃত্তি করছেন, কখনো বিবেক সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ক্যাডারের ভূমিকায়।...এখান থেকে বের হওয়ার পথ দরকার। না হলে সমাজ অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।’ অনুগ্রহ বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে (একান্ত বৈঠকের জন্য) ১৪০ জন সফরসঙ্গী যদি নেওয়া হয়, তাহলে তো তা সম্ভব হবে না। সর্বক্ষেত্রে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্যই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে তীক্ষ নজরদারি যে অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি এই নিবন্ধের পরিসমাপ্তি টানছি (বিষয়টি অবশ্য আরও আলোচনার দাবি রাখে) প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে—‘সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ব্যক্তিবিশেষ, কোনো পরিবার বা অন্য কারও আজ্ঞাবহ দাস নন। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন নিজ গুণে রিপাবলিকের সেবক হিসেবে। তাঁদের অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।
সূত্র - দৈনিক প্রথম আলো

Wednesday, September 18, 2013

আবদুল কাদের মোল্লার দন্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন


আবদুল কাদের মোল্লার দন্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন

জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ঘোষনার পর কয়েকটি প্রশন বার বার মনে পড়ছে। ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’ ইংরেজী ৪টি শব্দের এই বাক্যটি ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভেতরে। এই বাক্যটি খোদ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বিচারের আসনে বসেই অত্যন্ত দাম্ভিকতার সঙ্গে উচ্চারন করেছিলেন। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও আমাকে ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট দন্ড দেয়ার আগে এটি উচ্চারণ করেছিলেন আপিল বিভাগ। আদালত অবমাননার মামলার শুনানীতে আমার দেশ সম্পাদক যখন আমার লেখা ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে প্রতিবেদনের পক্ষে প্রমান উপস্থাপন করছিলেন তখন আপিল বিভাগ এ মন্তব্যটি করেছিল।

সুপ্রিমকোর্টের অনেক সিনিয়র আইনজীবী সহ শতাধিক আইনজীবী সেদিন উপস্থিত ছিলেন। কেউ এই বাক্যটির প্রতিবাদ করেননি। তখন ধরে নিয়েছিলাম সত্য উদঘাটন করা সুপ্রিমকোর্টের কাজ নয়। সত্য ন্যায় বিচারের ভিত্তি হতে পারে না। সত্য যতই সত্য হোক সেই প্রমান কাজে লাগবে না। আদালত যেটা চাইবে সেটা-ই হবে। সত্য আসলে ডিফেন্স নয়। না হলে কী আপিল বিভাগ বিচারকের আসনে বসে বলতে পারে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স। সত্য উদঘাটন করা সুপিমকোর্টের কাজ হলে আইনজীবীরা অন্তত এই বাক্যটির প্রতিবাদ করতেন। যেহেতু আইনজীবীরাও চুপ করে বসে ছিলেন আমরা ধরে নিয়েছি আসলেও আপিল বিভাগে সত্য ডিফেন্স নয়।

আবদুল কাদের মোল্লার মামলায়ও নানা রকম কথা প্রচারিত রয়েছে। তিনি আদৌ রাজাকার ছিলেন নাকি মুক্তিযোদ্ধ ছিলেন এনিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি একটি টকশো অনুষ্ঠানে বলেছিলেন আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর কমান্ডার কে ছিল সেটাও তিনি সেই অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন। ট্রায়াল কোর্ট শোনা সাক্ষীর ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দন্ড দিয়েছিল।

আদালতের বাইরে চাউড় রয়েছে আবদুল কাদের মোল্লা রাজাকার নন, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যেমনটা বলেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। কোনটা সত্য! এর বাইরে একেবারে প্রামান্য এবং বাস্তব সত্য হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে আবদুল কাদের মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেছেন। তাঁর ডিপার্টমেন্টে তিনি প্রথম শ্রেনীতে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এতবড় কসাই রাজকার হয়ে থাকলে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপটের সঙ্গে অধ্যয়ন সমাপ্ত করার কথা নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কসাই রাজাকার হয়ে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পরপর তখন-ই উদয়ন স্কুলে চাকির পাওয়ারও কথা নয়। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের দপুটে শাসন চলছিল। এত বড় কসাই রাজাকার শেখ মুজিবের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম তারপর উদয়ন স্কুলে চাকির প্রাপ্তি ! বিষয়টা যেন কেমন লাগে।

আবদূল কাদের মোল্লার স্ত্রীর একটি স্টেটমেন্ট অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরিও দিয়েছিলেন। সেটা সত্য হয়ে থাকলে আর আবদুর কাদের মোল্লাহ কসাই রাজাকার হলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে চাকরি দিলেন কেমন করে! রাজাকার হলেতো অন্তত তাঁকে চাকরি দেয়ার কথা নয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে আবদুল কাদের মোল্লাহ রাইফেলস্ স্কুল এন্ড কলেজে চাকরি করেন এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তখন পর্যন্ত কিন্তু আবদুর কাদের মোল্লাহ এত বড় কসাই রাজাকার ছিলেন বলে কেউ শোনেননি।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর-ই চিহ্নিত রাজার ও দালালদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে বিচার শুরু হয়েছিল। তখন হাজার হাজার লোককে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। সেই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কিন্তু আবদুল কাদের মোল্লার জায়গা হয়নি। এত বড় কসাই রাজাকার হয়ে থাকলে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তখন কেন একটি মামলা বা একটি জিডিও কোন থানায় দায়ের হয়নি! রাজকারের তালিকায় ঠাঁই হলো ২০১০ সালে এসে। আবদুল কাদের মোল্লার মানবতা বিরোধী অপরাধী হলেন ২০১০ সালে। কিন্তু দালাল আইনে যখন হাজার হাজার লোক গ্রেফতার হলেন, বিচার শুরু হলো তখনতো তাঁর বর্তমান দল জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় ছিল না। ১৯৭২ সালের পর যখন দালাল আইনে বিচার চলছিল তখনতো মুক্তিযুদ্ধের স্যোল এজেন্ট দাবীদার আওয়ামী লীগ-ই ক্ষমতায় ছিল। তখন কেন আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার বা তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ কোথায়ও দায়ের করা হয়নি। এটাতো বলার সুযোগ নেই বৈরী সরকার ক্ষমতায় থাকার কারনে তখন অভিযোগ দায়ের করা যায়নি। তবে তখন কেন এত গুলো হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির নামে কোন মামলা হয়নি?

আরেকটি বিষয় এখানে প্রশ্ন জাগে। আবদুল কাদের মোল্লা ছাত্র জীবনে দীর্ঘ সময় প্রগতির দাবীদার ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নেতা ছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী। স্বাধীনতার পর পর কিন্তু আবদুল কাদের মোল্লার নেতা মতিয়া চৌধুরী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানিয়েছেন। কিন্তু হালে তিনি বড় আওয়ামী লীগার। আর তাঁরই এক সময়ের রাজনৈতিক অনুজ আবদুল কাদের মোল্লাহ হলেন কসাই রাজাকার! রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরী তাদের রাজনৈতিক অনুজ সম্পর্কে কী বলবেন! তারা কী বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন আবদুল কাদের মোল্লাহ তাদের ছাত্র রাজনীতির অনুজ ছিলেন না! এজন্যই বার বার আমার হৃদয় ক্যম্পাসে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের সেই অমীয় বানী ‘ট্রুত ইজ নো ডিফেন্স’।

এই কথা বলে আমার প্রিয় সম্পাদক ও আমাকে দন্ড দেয়ার পর জ্যষ্ঠতম আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম কোর্টের ভেতরে-ই। স্যার এটা কেমন রায় হলো? উত্তরে তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলে ছিলেন ‘আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করো তোমাদের ফাঁসি দেয়নি’! আজ মনে হচ্ছে তা-ই সুপ্রিমকোর্ট চাইলে ফাঁসি দিতে পারতো।

আবদুল কাদের মোল্লার ট্রায়ালের সময় কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। সবাই শোনা কথা জানিয়েছেন ট্রায়ালকোর্টে। শোনা কথার সাক্ষীতে চরম দন্ড হতে পারে সেটা বোধ হয় আমাদের এই বাংলাদেশে-ই সম্ভব। আরো একটি প্রশ্ন জাগে, এত গুলো লোক হত্যাকেন্ডর দাবীতে আবদুল কাদের মোল্লাকে শোনা সাক্ষীর ভিত্তিতে প্রথম যাবজ্জীবন এবং পরবর্তিতে ফাঁসির দন্ড হল। এত গুলো লোককে যিনি হত্যা করতে পারেন না তাঁর হুকুমে হত্যাকান্ড সংঘঠিত হতে পারে তিনিতো বিরাট কিছু। এতগুলো হত্যাকাান্ডের সঙ্গে যিনি জড়িত মুক্তিযুদ্ধের পরপর তাঁর নাম উঠে আসল না কেন? আবদুল কাদের মোল্লার হুকুমে যারা হত্যাকান্ড গুলো সংঘটিত করেছে তাদের একজনেরও নাম ঠিকানা পাওয়া গেল না! আবদুল কাদের মোল্লাহ একাই শুধু দায়ী হলেন! বিচার শুধু একজনের হবে! বাকীরা কোথায়! রাজকার, আল বদরের সদস্য সবাইতো বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। তারা তো বাংলাদেশেই রয়েছেন। তাঁর সহযোগি একজনকেও খুজে পাওয়া গেল না! নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটাই সত্য?
আবদুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে েএকটি ভিডিও যেখানে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা গনস্বাস্থ্যের পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আসম আবদুর রব চানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রার টকশোতে বক্তব্য  উপস্থাপিত না করে পারলাম না।  ভিডিও টি শুনুন এই লিঙ্ক - 
আবদুল কাদের মোল্লাকে প্রথমে ট্রায়াল কোর্ট (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) যাবজ্জীবন দন্ড দিয়েছিল। এই দন্ড ঘোষণার পর ভারতীয় পত্র পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ভারতের টাকায় শাহবাগে আন্দোলনের খুটি বসানো হয়। গণজাগরনের নামে জড়ো করা হয় হাজার হাজার মানুষ। দিনের পর দিন গুরুত্বপূর্ন রাস্তা অবরোধ করে রাখে তারা। বিরিয়ানি খাইয়ে টাকা বিতরন করে জিয়ে রাখার চেস্টা করা হয় সেই গণ জাগরণ। সেখানে দিনে-রাতে তরুন, তরুণীদের অবাধ মেলা-মেশার সুযোগের কথা না-ই বা বললাম। তাদের দাবী ছিল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। বিচার নয়, ফাঁসি চাই সেই শ্লোগান ছিল শাহবাগে। সেই দাবী পূরনের জন্য-ই সংসদে আইন হল। মূল বিচার সমাপ্তির পর শুধু একজনকে ফাঁসি দেয়ার নিমিত্তে সংসদে আইন তৈরি হল শাহবাগের দাবীতে। সেই দাবী অনুযায়ী গত মঙ্গলবার আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হল। এটাকে ইনসাফ বা ন্যায় বিচারের কোন স্থরে স্থান দেয়া যায় সেই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে হয়ত কোন দিন নির্ধারিত হবে। 
লেখক: দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত,  সূত্র- দৈনিক আমাদের সময়


Friday, September 13, 2013

লতিফ সিদ্দিকীর দখল করা সাবেক প্রেসিডেন্টের বাড়ি উদ্ধার হয়েছিল যেভাবে

লতিফ সিদ্দিকীর দখল করা সাবেক প্রেসিডেন্টের বাড়ি উদ্ধার হয়েছিল যেভাবে
শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩
স্টাফ রিপোর্টার: আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী। সমপ্রতি নানা বিষয়ে আলোচিত তিনি। মার্কিন  রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিয়ে কৈফিয়ত চেয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে হরতালকারীদের ঘরে ঢুকে হত্যা করারও নির্দেশ দিয়েছেন এ নেতা। বক্তৃতা বিবৃতিতে নিজেকে আওয়ামী লীগের খাঁটি কর্মী প্রমাণ করতে চান তিনি। সমালোচনা করেন দলের প্রবীণ নেতাদেরও। আলোচিত এ নেতার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেও ছিলেন আলোচনায়। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। আর লতিফ সিদ্দিকী সংসদ সদস্য। সেই সময়ে নিজের লোকজন দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি দখল করে নিয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য ওই বাড়ি উদ্ধার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। রক্ষিবাহিনী অভিযান চালিয়ে ওই বাড়ি থেকে লতিফ সিদ্দিকীর লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ময়মনসিংহে। ওই বাড়ি উদ্ধারের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আনোয়ার উল আলমের বর্ণনায়। তিনি ওই সময় লেফটেনেন্ট কর্নেল মর্যাদায় রক্ষী বাহিনীর উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) ছিলেন।
‘রক্ষী বাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বইয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বইটির ‘বিরাগভাজন হওয়ার কয়েকটি ঘটনা’ উপ শিরোনামে আনোয়ার উল আলম ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
কোন বাহিনীর হয়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে ওই বাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেক সময় সরকারি দলের নেতা, কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরাগভাজন হতে হয়। এ বিষয়ে অবশ্যই পুলিশ বাহিনীর অভিজ্ঞতা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে বেশি। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর একজন উপ-পরিচালক হিসেবে আমি নিজেও কয়েকজন জনপ্রতিনিধির বিরাগভাজন হয়েছিলাম।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর কাজে যোগ দিয়ে আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে থাকি। কিছুদিন পর, একদিন সন্ধ্যায় আমি অফিসে কাজ করছি। আমাদের বাহিনীর পরিচালক এএনএম নূরুজ্জামান আমাকে ডেকে পাঠান। তার কাছে যাওয়ার পর তিনি আমাকে দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে শেরেবাংলা নগরের নতুন গণভবনে যাই। গণভবন ও আমাদের সদর দপ্তরের মধ্যে তেমন দূরত্ব ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি গণভবনে পৌঁছাই। প্রধানমন্ত্রীর সচিবের কাছে যাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমার উপস্থিতির কথা জানান। বঙ্গবন্ধু সচিবের মাধ্যমে আমাকে তার কক্ষে যেতে বলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসকক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সোফায় বসে আছেন।
বঙ্গবন্ধুর চেহারা দেখে আমার মনে হলো, তিনি খুব রাগান্বিত। এতে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভাবলাম, আমি কি কোন ভুল করে ফেলেছি? আমি বঙ্গবন্ধুর সামনে যেতেই তিনি আমাকে বললেন শোন, চৌধুরী সাহেবের পৈতৃক বাড়ি লতিফ দখল করেছে। ওই বাড়ি আজ রাতের মধ্যেই খালি করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। এ লতিফ টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। একই থানার নাগবাড়ি গ্রামে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিশাল পৈতৃক বাড়ি। লতিফ সিদ্দিকী ওই বাড়ি দখল করেছেন। আমি কোন কিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বললাম, খালি হয়ে যাবে, স্যার। এরপর বঙ্গবন্ধু আমাকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে সব জেনে কাজ করতে বললেন। নির্দেশ দিলেন বাড়ি খালি করে পরদিন সকালে যেন তাকে রিপোর্ট করি। তারপর আমাকে সাবেক রাষ্ট্রপতির কাছে রেখে বঙ্গবন্ধু পাশের ঘরে গেলেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এমনিতেই খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং গম্ভীর মানুষ ছিলেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। এ সুবাদে তিনি আমাকে ভাল করেই চিনতেন। তখন থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর ১০ই জানুয়ারি (১৯৭২) দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যখন তাকে রাষ্ট্রপতি করবেন বলে মনঃস্থ করেন, তখন আমাকেই তার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
একান্ত ব্যক্তিগত এবং প্রাসঙ্গিক না হলেও উল্লেখযোগ্য বলে ঘটনাটির অবতারণা করছি। ১১ই জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে আমরা কয়েকজন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টা। ভেতরে প্রবেশ করেই জানতে পারলাম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ঊর্ধ্বতন নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দোতলায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করছেন। আমরা নিচতলায় বসতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি, বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুসহ তাদের সবাইকে সালাম দিলাম। বঙ্গবন্ধু নেতাদের বিদায় দিয়ে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। মনে হলো, আমাদের পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। আমাদের কাছে নানা বিষয়ে জানতে চাইলেন। তবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মনে হলো, তিনি বেশ ক্লান্ত। তাই বেশিক্ষণ কথা না বলে আমি তাকে বললাম, আপনাকে শুধু দেখতে এসেছি। এ কথা বলে সবাই বিদায় নিচ্ছি, বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বললেন, তোর ভিসিকে তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে আয়।
উল্লেখ্য, আবু সাঈদ চৌধুরী ৭ই জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরেন। সেদিন আমি তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমার কাছে টাঙ্গাইলের খবর জানতে চান। আমি সংক্ষেপে কিছু ঘটনা জানাই।
১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে বেরিয়ে আমার সহযোদ্ধা নূরুন্নবী ছাড়া সবাই টাঙ্গাইলে রওনা হলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাতেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাসায় হাজির হলাম। সঙ্গে নূরুন্নবী। তার বাসায় গিয়ে জানতে পারি, তিনি শহীদ মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী ও সন্তানদের সমবেদনা জানাতে তার বাসায় গেছেন। কখন ফিরবেন, ঠিক নেই। এ অবস্থায় আমি শহীদ মুনীর চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার বাসা ছিল ভূতের গলিতে। এটা অবশ্য আমি জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে আমি ওই বাসায় যাই। সেখানে আমি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। বিনীতিভাবে তাকে জানাই, বঙ্গবন্ধু আমাকে পাঠিয়েছেন। আমরা আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। না পেয়ে এখানে এসেছি। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা এসেছি। এরপর তিনি মুনীর চৌধুরীর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে রওনা হন।
আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন রাত প্রায় ১১টা। বঙ্গবন্ধু সবে রাতের খাবার সেরে উঠেছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু তাকে সঙ্গে নিয়ে তার শয়নকক্ষে যান। নূরুন্নবী আর আমি নিচে অপেক্ষা করতে থাকি। একটু পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিচে নেমে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তখন কারণ বুঝতে পারিনি। পরদিন রেডিওতে খবর শুনে কারণটা বুঝতে পারি। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন।
যা হোক, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বাড়ি দখলের বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে একটু বিব্রত বোধ করছিলেন। তা করারই কথা। কারণ, কোন দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি বেদখল হওয়ার ঘটনা একটা অচিন্তনীয় বিষয়। আমি নিজেও বেশ লজ্জা বোধ করছিলাম। আমি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে সব শুনে তাকে আশ্বাস দিলাম যে রাতের মধ্যেই তার বাড়ি খালি হয়ে যাবে। এরপর আমি অফিসে ফিরে আসি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বাসভবনে ফিরে যান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তার পারিবারিক বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য সামসুদ্দিন (মুচু মিয়া) নামের একজন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তাকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, সাবেক রাষ্ট্রপতির পৈতৃক বাড়ি দখলদার সংসদ সদস্যের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাই আমি কৌশল ঠিক করলাম, উদ্ধার অভিযানটা পরিচালনা করতে হবে সঙ্গোপনে। টাঙ্গাইল জেলায় কোন দিন কোন অভিযানে রক্ষীবাহিনী পাঠানো হয়নি। আশাপাশে রক্ষীবাহিনীর কোন ক্যাম্প ছিল না। কাছাকাছি ময়মনসিংহে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেখানে বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন লিডার সরোয়ার হোসেন। তার বাড়ি ছিল কালিহাতী থানার পাশেই বাসাইল থানায়। মুক্তিযুদ্ধকালে সরোয়ার কালিহাতী এলাকায় যুদ্ধ করেন। ফোন করে তাকে নির্দেশ দিলাম দুই ট্রাক রক্ষী সদস্য প্রস্তুত করে রাত একটার মধ্যে নাগবাড়ী পৌঁছাতে এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি ঘেরাও করে ভেতরে যাকেই পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে ট্রাকে উঠিয়ে সরাসরি ময়মনসিংহে নিয়ে যেতে। আরও নির্দেশ দিলাম গভীর রাতে অপারেশন করার জন্য। গ্রামের লোকজন যাতে এ অপারেশনের বিষয়ে জানতে না পারে, তার জন্য নীরবে কাজ করতে হবে। কোন গুলি করা যাবে না। তারপর ময়মনসিংহে ফিরে সকালেই আমাকে জানাতে হবে।
যে রকম নির্দেশ, সে রকম কাজ। সকাল ছয়টার দিকে ময়মনসিংহে ফিরে লিডার সরোয়ার হোসেন আমাকে ফোন করে জানালেন, অপারেশন সফল। তারা নাগবাড়ীতে গিয়ে দেখেন গ্রামটি নীরব, নিস্তব্ধ। লোকজন সবাই ঘুমে, এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি যারা দখল করে আছে, তারাও ঘুমে। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে তাদের সবাইকে (যত দূর মনে পড়ে ১৫-১৬ জন) ধরে কোন হট্টগোল ছাড়াই রক্ষী সদস্যরা ফিরে আসেন। আমি সরোয়ারকে দুপুরের আগেই একটা রিপোর্ট লিখে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার জন্য বলি।
এরপর অফিসে গিয়েই আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ফোন করে জানাই, তার বাড়ি খালি হয়ে গেছে। সেখানে তার লোকজন যেতে পারে। তারপর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে রিপোর্ট করতে গণভবনে যাই। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি দখলমুক্ত হয়েছে জেনে তিনি খুব খুশি হন এবং নিজেই তাকে ফোন করেন।
এদিকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সকালেই খবর পেয়ে যান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি থেকে তার লোকজনকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে গেছে। এ খবর পেয়ে লতিফ সিদ্দিকী এদিক সেদিক খোঁজ নিতে থাকেন, কিন্তু কোন খবর পান না। কারণ, টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) বা কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেউই বিষয়টি জানতেন না। দু’তিন দিন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ না পেয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীর সঙ্গে দেখা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানান, তিনিও এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে তার কাছ থেকেই হয়তো লতিফ সিদ্দিকী খবর পান, বিষয়টা আমি জানি।
দু’তিন দিন পর একদিন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমার বাসায় আসেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাকে বলি যে ব্যাপারটা ঘটেছে অনেক উঁচুপর্যায়ের সিদ্ধান্তে। এর বেশি আমি জানি না। এটা জানতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হবে। আমার কাছে সদুত্তর না পেয়ে লতিফ সিদ্দিকী অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তারপর চলে যান আমার বাসা থেকে। আর কোন দিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সম্পত্তির ধারে কাছে যাননি তিনি। 

Monday, September 9, 2013

বাংলাদের গর্ব - সালমান খান - বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ ৫০ প্রভাবশালীর তালিকায়

বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ ৫০ প্রভাবশালীর তালিকায় সালমান

বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনলাইনভিত্তিক শিক্ষক সালমান খান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ব্লুমবার্গ মার্কেটস এ তালিকা প্রকাশ করেছে।

সালমান যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে থেকে একযোগে সারা বিশ্বের কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে শিক্ষা বিতরণ করে চলেছেন। তাঁর অভাবনীয় শিক্ষা পদ্ধতি ও এর সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি সার্চ ইঞ্জিন গুগলের কাছ থেকে 'ওয়ার্ল্ড চেঞ্জিং আইডিয়া'র পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'খান একাডেমী' নামে অনলাইন ভিডিও টিউটরিয়াল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এখন ২৯টি ভাষায় পুরোদমে শিক্ষা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।


নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাণিজ্যবিষয়ক মাসিক সাময়িকী ব্লুমবার্গ মার্কেটসের পাঠক রয়েছে বিশ্বের ১৪৭টি দেশে। অর্থনীতি বা বাজারে অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিশ্বে পরিবর্তন আনতে পারে এমন প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তিকে নিয়ে তিন বছর ধরে তালিকা তৈরি করছে তারা। এবারের তালিকাটি তাদের অক্টোবরের ইস্যুতে প্রকাশ করা হবে। এর আগেই তাদের অনলাইন সংস্করণে এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়। এতে দেখা যায়, চিন্তাশীল ব্যক্তি (থিংকার) বিভাগে নাম এসেছে সালমান ও তাঁর খান ফাউন্ডেশনের। তাঁর তৎপতার শুরুর দিকটাও উল্লেখ করা হয়েছে এতে। সালমানের অলাভজনক শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটে বর্তমানে চার হাজার ৫০০ ভিডিও রয়েছে।

সালমানের বাবা বরিশালের মানুষ। তাঁর জন্ম অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অরলিন্সে। সালমান বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইআইটি) থেকে তিন বিষয়ে স্নাতক এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করেন।

সালমানের অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিকে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস অভিহিত করেছেন 'ভবিষ্যতের শিক্ষা' হিসেবে। পাঠদান পদ্ধতির কারণে তিনি ইতিমধ্যেই টাইম ও ফোর্বস সাময়িকীর প্রভাবশালীর তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছেন।
বি.দ্র. বরেন্য  সালমান খানের “ খান একাডেমীর “ ওয়েব সাইটের জন্য ইংরেজী(একানে ক্লিক)বাংলা (একানে ক্লিক) করুন। অসীম জ্ঞানের ভান্ডার না পড়লে জীবনের সেরা ভুলেরে একটি হবে।
 সূত্র - কালের কণ্ঠ

ফেলানী র্হ্ত্যাকান্ড (রাষ্ট্রিয় নতজানু পররাষ্ট্র নীতির ফল) ও সালমানের হরিণ শিকার

সালমানের হরিণ শিকার ও ফেলানী

 ফেলানী র্হ্ত্যাকান্ড (রাষ্ট্রিয় নতজানু পররাষ্ট্র নীতির ফল) ও সালমানের হরিণ শিকার 
Untitled-2
বলিউডের নায়ক সালমান খান। তিনি শিকার করেছিলেন একটা বিরল প্রজাতির হরিণকে। ১৪ বছর আগে রাজস্থানে শুটিং করতে গিয়ে তিনি এই শিকারকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তাঁর বিচার হচ্ছে ভারতের আদালতে। শুধু সালমান খানের নয়, তাঁকে এই শিকারে উৎসাহিত করার অভিযোগে বিচার হচ্ছে সাইফ আলী খান, সোনালি বেন্দ্রে প্রমুখের। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সালমান খানের তিন বছর থেকে ছয় বছরের জেল হতে পারে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সংঘটিত এক হত্যাকাণ্ডের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছেন। কি বাংলাদেশে, কি বাংলাদেশের বাইরে, বিবেকবান মানুষের হূদয় বিদীর্ণ হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে আছে এক কিশোরী। তার পা ওপরের দিকে, চুল নিচের দিকে। তার গায়ে লাল রঙের শীতপোশাক, পরনে নীল বস্ত্র। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়ে সে ঝুলে ছিল অনেকক্ষণ। পরে জানা যায়, বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের এক গ্রামের মেয়ে ফেলানী। সে পড়ে ভারতের আসামের এক মাদ্রাসায়। ১৪ বছরের এই মেয়েটিকে তার বাবা দেশে ফিরিয়ে আনছিলেন বিয়ে দেবেন বলে। ছবিতেই দেখা যায়, বেড়ার গায়ে একটা বাঁশের মই। ওই মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরোনোর চেষ্টা করছিল ফেলানী। বাবা সীমানা পেরিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু মেয়েটিকে গুলি করেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য। রঙিন জামাসমেত ঝুলে থাকে এক শিশুর দেহ। ওই ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মানুষ। ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ক্ষোভ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ-ভারতের ২৪২৯ মাইল অভিন্ন স্থলসীমান্ত বেশ জটিল। অনেকগুলো ছিটমহল আছে, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন হয়নি, এমন জায়গা আছে। আমি আখাউড়া এলাকায় এমন বাড়ি দেখেছি, যার একটা ঘর পড়েছে ভারতে, একটা ঘর বাংলাদেশে। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বিয়েশাদি হয়েছে, আত্মীয়স্বজন আছে, সীমান্ত হাটগুলোতেই বোঝা যায়, আদান-প্রদানও আছে। ফেলানী নিজেই সাক্ষী যে বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবৈধ পথে ভারতে যায়। আবার ভারতীয়রাও বাংলাদেশে আসে। আমি কক্সবাজারে একজন রিকশাওয়ালা পেয়েছিলাম, তাঁর কথার সুর ও স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি হয় খুবই শিক্ষিত, নয়তো এ দেশের নন। খানিকক্ষণ আলাপের পর তিনি জানালেন, তাঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে, সমুদ্র দেখার জন্য তিনি চলে এসেছেন কক্সবাজারে, এখন রিকশা চালিয়ে খরচ তুলছেন। ঢাকায় বহু ভারতীয় নাগরিক কাজ করছেন, যাঁদের অনেকেরই হয়তো ওয়ার্ক পারমিট নেই। অন্যদিকে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ে স্পর্শকাতরতা আছে। বেশ কটা জঙ্গি হামলা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে, মুম্বাই হামলা থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা। তারা সীমান্তকে নিশ্ছিদ্র করতে চায়। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের যে বৈশিষ্ট্য, তাতে কথায় কথায় গুলি চালানো হবে সবচেয়ে অবিবেচকের কাজ। কেবল শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের সীমান্তেই দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। অনেকে বলেন, দুই দেশের সীমান্তে যত হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার মূলে রয়েছে চোরাচালান ও দুর্নীতি। কেবল বখরার গন্ডগোল হলেই গুলি চলে। দুই দেশের মধ্যে স্থলবাণিজ্য যত সহজ, যতটা বৈধ করা যাবে, এই সমস্যার সমাধান ততই অর্জনযোগ্য হয়ে উঠবে। আর দরকার ছিটমহল বিনিময়, সীমানা চিহ্নিত করা। ছিটমহল বিনিময় কেন হচ্ছে না, কোন পক্ষ এটা আটকে রেখেছে, আমরা জানি। ভারতের সংসদে এটা অনুমোদন করা হচ্ছে না। ৬৬ বছর পেরিয়ে গেল, ছিটের মানুষেরা রাষ্ট্রহীন হয়েই রইল। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও তাই চায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত জনমত জরিপে আমরা দেখেছি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হোক, এটা এই দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই চাওয়া। ভারতের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া ছিল তাদের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করা, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা। বাংলাদেশ স্পষ্টভাবেই অবস্থান নিয়েছে, বাংলাদেশের মাটিকে ভারতবিরোধী জঙ্গি তৎপরতার জন্য ব্যবহূত হতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ অতিবিখ্যাত তিতাস নদের ওপরে মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করে ভারতে ভারী পণ্যবাহী যান চলাচলে সাহায্য পর্যন্ত করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে যখন এলেন, তখন ব্যাপক আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে অন্তত তিস্তা নদীর পানি বিনিময় চুক্তি হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসলেন, মনমোহনের সফরসঙ্গী হলেন না। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হলো না। ওই সময় আমি এই কলামে লিখেছিলাম প্রিন্স মাহমুদের একটা গানের কথা, দু পা আমি এগিয়েছি, দু পা তুমি পিছিয়েছ, এভাবে ভালোবাসা হয় না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানুষ হত্যা শূন্যে আনা হবে, নেতৃত্বের পর্যায়ে এ কথা অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। মনমোহন সিং বাংলাদেশে যখন এসেছেন, তখন হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত বিএসএফ-বিডিআর বা বিজিবি পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে, সচিব পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে। সীমান্তে লোক অবৈধভাবে যাতায়াত করলে উভয় দেশের বাহিনী বাধা দেবে, বলপ্রয়োগও করতে পারে; কিন্তু গুলি হওয়া উচিত একেবারে শেষতম অস্ত্র, কেবল জঙ্গি, ডাকাত, আক্রমণকারীদের ওপরেই যা ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব কথা যখন ঢাকায় কিংবা দিল্লিতে উচ্চারিত হয়, উভয় পক্ষই একমত হয়, আর সীমান্ত হত্যা নয় বলে অঙ্গীকার শোনা যায়, ঠিক তখনই সীমান্ত থেকে খবর আসে, আবারও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বিএসএফ কর্তৃক ৯৫ জন, ২০০৭ সালে ৮৭ জন বাংলাদেশি নিহত হন, তুলনায় ২০১১ সালে ৪৮ জন মারা যান। ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড যদি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে একটা দৃষ্টান্ত তো স্থাপন করতে হবে। ফেলানীর মামলাটা হতে পারত সেই দৃষ্টান্ত। ফেলানী শিশু, ফেলানী নারী। মই বেয়ে যেভাবে সে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকছিল, তাতেই স্পষ্ট, সে চোরাকারবারি নয়, জঙ্গি দলের সদস্যও নয়। তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। সে কাউকে গুলি করেনি। সম্মিলিত চোরাকারবারিদের মতো লাঠি হাতে তেড়েও আসেনি। তাকে গুলি করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। তার পরেও গুলি হয়েছে। বালিকার দেহ জর্জরিত হয়েছে। তার নিস্পন্দ দেহ ঝুলে থেকেছে কাঁটাতারের বেড়ায়। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এবং ঘোষণা এসেছে, এই প্রথম সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বিএসএফের কোনো একজন সদস্যের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন এই খবরের ফলোআপ খবর ছাপা হয়েছে। ফেলানীর বাবা সাক্ষ্য দিতে ভারতে গেছেন। সবার দৃষ্টি যখন বিচারের রায়ের দিকে, তখন আমরা জানতে পারলাম, অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ পর্যন্ত বলেছে, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। কারণ, বিচার হয়েছে বাহিনীসমূহের বিশেষ আদালতে, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে, ফৌজদারি আদালতে নয়। এই রায় কী বার্তা দিচ্ছে? যে বার্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় ঘোষিত হয়েছিল, যে বার্তা বিভিন্ন স্তরের বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকে বারবার উচ্চারিত হয়েছে, আর সীমান্ত হত্যা নয়, সীমান্তে আর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটবে না, একেবারে নিজেদের ওপরে আঘাত না এলে গুলি করা হবে না। সেই বার্তাসমূহ একেবারে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া হলো। এখন বিএসএফ সদস্যরা এই বার্তাই পেলেন যে একটা ১৪ বছরের নিরস্ত্র কিশোরীকেও গুলি করা চলে এবং তাতে কোনো সাজা হয় না, দোষ হয় না। দুটি দেশ, যারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর, কাগজ থেকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য রাজনৈতিক পর্যায়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, সেখানে এর চেয়ে ভয়ংকর বার্তা আর কী হতে পারে? বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার এক বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, বিচার শেষ হয়নি, এই রায় রিভিউ হবে, দোষীরা অবশ্যই উপযুক্ত সাজা পাবে। এখনই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া তাই দেখানোর সময় নয়। আমরা বলব, এখনই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়। ভারত এই বিচার উন্মুক্ত ফৌজদারি আদালতে আনুক। আমরা জানি, সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। কালকেও টেলিভিশন খবরে দেখলাম, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর লাশ পড়ে আছে সীমান্তে। এই হত্যাকাণ্ড যদি বন্ধ করতে হয়, অন্তত কমিয়ে আনতে হয়, ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হতে পারে উদাহরণ। সেটা বিপরীত উদাহরণ সৃষ্টি করলে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। বিএসএফ সদস্যরা গুলি করতে উৎসাহিত বোধ করতে পারেন। তরুণ লেখক আসিফ এন্তাজ তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন: পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। একটা বাঘ হত্যা করলে, সেটার জন্য বিচার হয়। জেল হয়, জরিমানা হয়। একটা পাখি গুলি করে মেরে ফেললে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এমনকি একটা গাছ কেটে ফেললেও সেটার জন্য শাস্তি পেতে হয়। শুধু ‘গরিব মানুষ’ মারলে ছুই হয় না। সত্যি তো, হরিণ শিকার করার জন্য সালমান খানের মতো তারকার বিচার হচ্ছে, অথচ ফেলানী হত্যাকাণ্ডে বিচারে কারও সাজা হবে না? বাংলাদেশের মানুষের মনে ফেলানী হত্যাকাণ্ডে বিচারের রায়ের খবর গভীর ছায়া ফেলেছে। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য যা মোটেও ভালো খবর নয়।
সূত - প্রথম আলো, আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।