১ শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কোনো ক্যু সফল হবে না। তাই ক্যু সফল করতে হলে শেখ হাসিনার কাছে পৌছাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন (গণভবন) যে গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে তারা শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বস্ত। এই গার্ডরা ভেতরে কাউকেই কোনোভাবেই ঢুকতে দেবে না। তাছাড়া, আমি মনে করি, কোনো ক্যু-র প্রচেষ্টা এত রক্তক্ষয়ী হবে যে, সেই ঝুকি নেওয়ার মতো কোনো অফিসার নেই। আমি আপনাকে বলতে পারি যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। সেটা হতে পারে শুধুমাত্র আমাদের লাশের ওপর দিয়ে।
- ঢাকায় ইনডিয়ান সাংবাদিক দেবদীপ পুরোহিতকে দেওয়া সজীব ওয়াজেদ জয়-এর ইন্টারভিউয়ের একাংশ যা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৪ নভেম্বর ২০১৩-তে।
To have a successful coup, you will have to physically get Sheikh Hasina to hand over power. The guards guarding this house (Gano Bhaban, the official residence of the Prime Minister) are faithful to Sheikh Hasina. There is no way the guards will allow anybody to step in.
Besides, any (coup) attempt will be so bloody that I don’t think there is any group of officers inclined to take that risk. I can tell you that Sheikh Hasina will not hand over power. It can only happen over our dead bodies.
-Sajib Wazed Joy, in an interview taken by Devadeep Purohit in Dhaka and published in the Telegraph, Calcutta, India on 24 November 2013.
২ বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) তার চূড়ান্ত মতামত মুজিব কাকুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সায়ীদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি মুজিব কাকুকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই... বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সবসময়ে, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্র শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।... বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দি ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশন (...আপনার অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আপনাকে সরিয়ে দেওয়ার সব দরজাই আপনি এই পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন)।
- শারমিন আহমদ: তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা (পৃষ্ঠা ১৯১-১৯২)
৩ ক্ষমতাসীনকে প্রশ্ন করুন, কিভাবে আপনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং কিভাবে আমরা আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারি? রাজনীতিতে এই দুটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
- টনি বেন
টনি বেন কে ছিলেন এই প্রশ্নটির উত্তর হয়তো বাংলাদেশের অনেকেরই জানা নেই।
বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে বৃটেনের বামপন্থী রাজনীতিতে টনি বেন ছিলেন একজন প্রধান নেতা যার ওপর অনেক সময়ে নির্ভর করতো লেবার পার্টির সাফল্য এবং ব্যর্থতা। প্রতিপক্ষ টোরি বা কনজারভেটিভ পার্টি দ্বারা তিনি যেমন সমালোচিত হতেন, ঠিক তেমনি তার নিজের লেবার পার্টির মধ্যেও তিনি বিতর্কিত হতেন। কিন্তু দুটি দলই স্বীকার করতে বাধ্য হতো টনি বেনের ভূমিকা অনেক সময়ে ছিল দলের ঊর্ধ্বে- দেশের স্বার্থে। তাই টনি বেন ছিলেন নিজেই একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
টনি বেনের এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর, গভীর আত্মবিশ্বাস এবং ধূমায়িত পাইপ হাতে মগে চা খাওয়া।
১৪ মার্চ ২০১৪-তে টনি বেন ৮৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী টোরি পার্টির নেত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো তিনি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। নিজের পার্টি, লেবার পার্টির পক্ষ থেকে তিনি কখনো পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারেন নি। তবে তিনি একবার লেবার পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু টনি বেন ১৯৫০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ১৬ বার পার্লামেন্টের সদস্য বা এমপি নির্বাচিত হন। লেবার পার্টির মধ্যে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হবার রেকর্ড তারই।
রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত
তার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ সম্মান জানানোর প্রস্তাব ওঠে। এ নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কারণ মার্গারেট থ্যাচার নিজের মৃত্যুর আগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়। তার সেই অনুরোধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু টনি বেন, যিনি শাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন, তিনি নিজের মৃত্যুর আগে এই ধরনের জাকজমক ভরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোনো অনুরোধ করে যান নি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে করার জন্য অনুমতি নিতে হয় বৃটিশ রানীর। কিন্তু বেন ছিলেন বৃটেনে রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষপাতী।
এই প্রেক্ষিতে বৃটিশ জনগণ আশ্চর্য হয়ে যায় যখন জানা গেল বর্তমানে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে টনি বেনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ বিদায় দেওয়ার জন্য এবং রানী এলিজাবেথও তার অনুমতি দিয়েছেন। কিছু কট্টর ডানপন্থী টোরি এবং কিছু কট্টর বামপন্থী লেবার নেতাকর্মীরা মৃদু সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত টনি বেনের মরদেহ এনে রাখা হয় বৃটিশ পার্লামেন্টের নিজস্ব গির্জা সেইন্ট মেরি আন্ডারক্রফটে। একটি উচু টেবিলে তার কফিন ঢাকা হয় বৃটিশ পতাকা দিয়ে এবং তার ওপর রাখা হয় ফুলের তোড়া। এর আগে একমাত্র মার্গারেট থ্যাচারই এমন সম্মান পেয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ইন্টারনেট জুড়ে চলতে যাকে সকল দলের টপ নেতা, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পপস্টার এবং বৃটিশ সুধী সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীদের শ্রদ্ধাসূচক স্মৃতিচারণ। টনি বেনের সুদীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হতে থাকে রেডিও-টিভিতে। টনি বেনের স্মরণীয় বহু উদ্ধৃতি প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন ব্লগে।
বাংলাদেশিদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
এই ব্যাপক ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্যে বাদ পড়ে যায় টনি বেনের জীবনের একটি দিক এবং সেটি হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বৃটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন আন্দোলনকে তার সমর্থন দান।
টনি বেনকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারিতে শীতের এক বিকেলে সেন্ট্রাল লন্ডনে রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে একটি মিটিংয়ে। সেই সময়ে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রছাত্রীদের কার্যক্রম হোবর্নের এই অঞ্চল জুড়ে হতো। এখানেই অবস্থিত ব্যারিস্টার হতে আগ্রহীদের পীঠস্থান লিংকন্স ইন, ইকনমিস্ট হতে আগ্রহীদের লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স, অন্যান্য সব বিষয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডন ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সংক্ষেপে সোয়াস) এবং ছাত্রদের থাকার বিভিন্ন হল। এদের কাছেই ছিল বুশ হাউসে বিবিসি বাংলা বিভাগের দফতর যেটি এখন সরে গিয়েছে অন্যখানে। তাই ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ এখানে ঘটতো। কনওয়ে হলটি খুবই শাদামাটা বলে ভাড়া ছিল কম।
১৯৫৮-তে পাকিস্তানে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার সেনাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এই ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা সংক্ষেপে পিএসএফ। রাজনীতি সচেতন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা এই সংগঠনের সদস্য ছিল। তবে এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের একটা নিজস্ব ধারাও প্রবাহিত ছিল।
লর্ড উপাধি ছেড়ে দেওয়ার একক আন্দোলন
পিএসএফের আমন্ত্রণে সেই শীতের বিকেলে টনি বেন কনওয়ে হলে এসেছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার জন্য প্রধান অতিথি হয়ে। সেই সময়ে তার সম্পর্কে দুটি কথা জানতাম। এক. তিনি বৃস্টল সাউথ-ইস্ট আসন থেকে নির্বাচিত লেবার এমপি এবং দুই. বংশগত কারণে বৃটিশ আইন অনুযায়ী তিনি আর এমপি থাকতে পারবেন না তার পিতা ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পরে।
শেষের তথ্যটি আমাকে কৌতূহলী করেছিল।
বৃটেনের পার্লামেন্টে দুটি হাউস বা কক্ষ আছে। আপার হাউস বা উচ্চকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ লর্ডস বা লর্ডস সভা এবং লোয়ার হাউস বা নিম্নকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ কমন্স বা কমন্স সভা। বৃটেনে নির্বাচনে যারা বিজয়ী হন, তারা হন কমন্স সভার সদস্য বা এমপি এবং এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে পাচ বছর। পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে এরাই হন প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। এমপিদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা। অন্যদিকে উচ্চকক্ষে লর্ডরা সদস্য হন তাদের বংশগত যোগ্যতায় অথবা সরকারের মনোনয়নে। এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে আজীবন অথবা স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া পর্যন্ত। নিম্নকক্ষ কর্তৃক পাস হওয়া কোনো বিল পর্যালোচনা করা এবং সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য আবার নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠানো ছাড়া আর বিশেষ কোনো ক্ষমতা উচ্চকক্ষ সদস্যদের বা লর্ডদের নেই। তাই যারা রাজনীতি করতে চান এবং প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দেশ পরিচালনা করতে চান তারা হাউস অফ কমন্স বা নিম্নকক্ষের সদস্য হতে চান। অর্থাৎ, তারা হতে চান এমপি। অন্যভাবে বলা চলে, তারা লর্ড হতে চান না যদিও লর্ড শব্দটির সঙ্গে মর্যাদা, সম্ভ্রম এবং আভিজাত্য জড়িয়ে আছে।
১৯৬০-এ প্রচলিত বৃটিশ আইন অনুযায়ী লর্ডস সভার সদস্য ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট, যার পূর্ণ নাম ছিল উইলিয়াম ওয়েজউড বেন, তার মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র মাইকেলের হবার কথা ছিল ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট এবং সেই সুবাদে লর্ডস সভার সদস্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ওই পুত্রের মৃত্যু হওয়ায়, তার দ্বিতীয় পুত্র এনটনি নিল ওয়েজউড বেন, যিনি সংক্ষিপ্ত টনি বেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তাকেই উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডস সভার সদস্য হতে হতো। টনি বেন ইতিমধ্যে মাত্র পচিশ বছর বয়সে ১৯৫০-এ বিপুল ভোটে বৃস্টল সাউথ-ইস্ট থেকে লেবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি হয়েছিলেন পার্লামেন্টে সর্বকনিষ্ঠ এমপি বা বেবি অফ দি হাউস। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে পিতার মৃত্যুর পরে কিছুতেই তিনি নিম্নকক্ষ ছেড়ে উচ্চকক্ষে লর্ড হয়ে যাবেন না। তাই তিনি এককভাবে একটি আন্দোলন চালাচ্ছিলেন যেন বৃটিশ নাগরিকদের অধিকার থাকে লর্ডস সভার সদস্য পদ ছেড়ে দেওয়ার।
নভেম্বর ১৯৬০-এ ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পর টনি বেন অটোম্যাটিকালি হয়ে যান লর্ড এবং হাউস অফ কমন্সের দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এপৃল ১৯৬১-তে টনি বেনের আসনে উপনির্বাচন ধার্য হয়। টনি বেন এর বিরুদ্ধে কমন্সে একটি ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্পিকার তাকে ভাষণ দেওয়ার অনুমতি দেননি।
টনি বেন তার একক আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি জানতেন ভোটাররা তাকে চায় এবং তিনি এটাও জানতেন যে, বৃটিশ আইনে একটা ফাক আছে। কমন্সে ঢুকতে না পারলেও কমন্সের নির্বাচনে দাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এবং উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। বিষয়টি তখন ইলেকশন কোর্টে গড়ায়। আদালত রায় দেন যে ভোটাররা সচেতন ছিলেন। সুতরাং টনি বেনের পক্ষে তাদের ভোট দেয়া অনুচিত হয়েছিল। কমন্সে বেন ঢুকতে পারবেন না এবং উপনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী টোরি পার্টির প্রার্থী ম্যালকম সেইন্ট ক্লেয়ারকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। মজার কথা এই যে ম্যালকম সেইন্ট ক্লেয়ারের অবস্থাও টনি বেনের মতো ছিল। সেইন্ট ক্লেয়ারের পিতাও ছিলেন লর্ড এবং তার মৃত্যুর পর সেইন্ট ক্লেয়ারের কমন্স সভার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যেত।
আদালতের রায়ে গভীরভাবে হতাশ হলেও টনি বেন তার ক্যামপেইন চালিয়ে যেতে থাকেন।
ঠিক এই সময়টায় টনি বেনকে আমরা কয়েকবারই পেয়েছিলাম আমাদের ছাত্রসমাবেশে। তিনি সেখানে শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ে বলতে আসতেন। পরোক্ষভাবে এটা ছিল তার নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্যামপেইনের একটা অংশ।
বিজয়ী বেন
অবশেষে টোরি সরকার দি পিয়ারেজ অ্যাক্ট (The Peerage Act 1963) পাস করে, যার ফলে লর্ড পদবি ছেড়ে দেওয়া আইনসম্মত হয়।
৩১ জুলাই ১৯৬৩-তে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে এই আইনটি পাস হয়। বেন-ই ছিলেন প্রথম লর্ড যিনি তার পদবি ছেড়ে দেন। এটি তিনি করেন সেই দিনই সন্ধ্যা ৬-২২ মিনিটে!
সেই সন্ধ্যায় আমরা, বেন গুণগ্রাহীরা, একটি পাবে (Pub-G) কয়েক রাউন্ড বিয়ার কিনে তার এই ঐতিহাসিক সাফল্য সেলিব্রেট করেছিলাম। সেদিনের সান্ধ্য পত্রিকাগুলোতে ছিল শুধুই বেনের সাফল্যের সংবাদ।
চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য বেনকে অপেক্ষা করতে হয় আরো বিশ দিন। সেইন্ট ক্লেয়ার তার নির্বাচনের সময়ে বলেছিলেন, আইন বদলে গেলে তিনি এমপি পদ ছেড়ে দেবেন। সেইন্ট ক্লেয়ার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। বৃটিশ সাউথ-ইস্টে আবার উপনির্বাচন হয় ২০ আগস্ট ১৯৬৩-তে। ওই উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টনি বেন পার্লামেন্টে ফিরে আসেন।
ব্যক্তিগত ন্যায্য দাবি আদায় করার জন্য দেশের কয়েক শ’ বছরের পুরনো আইন বদলানোর লক্ষ্যে এককভাবে আন্দোলন করে সফল হওয়ার এই দৃষ্টান্ত আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন করে বিজয়ী হবার বহু দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এককভাবে আন্দোলন করে সফল হবার এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
মায়ের প্রভাব
টনি বেনের জন্ম হয়েছিল ৩ এপ্রিল ১৯২৫-তে লন্ডনে। তার পিতা ভাইকাউন্ট হবার আগে ছিলেন লেবার পার্টির এমপি এবং দুইবার মন্ত্রী। টনির মা মার্গারেট ছিলেন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী নেত্রী এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানী। টনির ওপর তার মায়ের প্রভাব পড়েছিল বেশি। মা যখন তাকে বাইবেল পড়াতেন তখন বলতেন, বাইবেলের গল্পগুলোর ভিত্তি হচ্ছে পয়গম্বর এবং রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ। রাজারা ছিল ক্ষমতাবান। কিন্তু পয়গম্বররা ছিলেন ন্যায় ও নীতিবান। সুতরাং টনির উচিত হবে তার নিজের জীবনে রাজাদের বিরুদ্ধে পয়গম্বরদের সাপোর্ট করা। সম্ভবত বৃটেনের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে টনি বেনের বিতৃষ্ণার সূচনা হয়েছিল তার মায়ের শিক্ষাতে।
টনি বেনের দাদা এবং নানা উভয়েই ছিলেন লিবারাল পার্টির এমপি। অর্থাৎ তিন পুরুষ ধরে টনি বেনরা ছিলেন এমপি। তিন পুরুষেই তারা হয়েছিলেন মন্ত্রী। তার পিতা যখন লেবার সরকারের ইনডিয়া দফতরের মন্ত্রী ছিলেন তখন ১৯৩১-এ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে টনি বেনের দেখা হয়েছিল।
বেনের পৈত্রিক পরিবারের মূল আয় ছিল একটি প্রকাশনা ব্যবসা থেকে। তিনি পড়াশোনা করতে যান অক্সফোর্ডে। ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি এয়ার ফোর্সে পাইলট রূপে যোগ দেন। যন্ত্র এবং আধুনিকতার প্রতি টনি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালেও তার এই আগ্রহ অটুট ছিল। যুদ্ধ শেষের পর তিনি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে যান এবং সেখানে ফিলসফি, পলিটিক্স ও ইকনমিক্স পড়েন। ১৯৪৭-এ তিনি অক্সফোর্ড ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন। তখন ধনী এবং অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই অক্সফোর্ড-কেমবৃজে পড়াশোনার সুযোগ পেত। সম্ভবত সেই কারণে সাধারণ মানুষের স্টেটাস পেতে উৎসাহী টনি বেন পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ডে তার লেখাপড়ার বিষয়টি অনুক্ত রাখতেন। ১৯৭৫-এ হু ইজ হু (Who's Who)জীবনীকোষে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন, শিক্ষা- এখনো চলছে (Education- still in progress)।
অসাধারণ পরিবার - সাধারণ নাম
১৯৪৮-এ গ্র্যাজুয়েট হবার পর কিছু কাল আমেরিকায় কাটিয়ে বেন বিবিসি রেডিওতে প্রডিউসার পদে কাজ করেন (১৯৪৯-৫০)। এই সময় পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এনটনি ওয়েজউড বেন এবং ওয়েজি নামে বন্ধুবৃত্তে ও পরিবারে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৩-এ বিবিসির একটি প্রোগ্রামে তিনি ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে এনটনি ওয়েজউড বেনের পরিবর্তে তিনি শুধু টনি বেন নামে পরিচিত হতে চান। এখানেও তার সেই একই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল। তিনি তার অভিজাত এবং দীর্ঘ নাম বদলে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সাধারণ ও সংক্ষিপ্ত নাম রাখেন। এই ধারাতে পরবর্তীকালে আমেরিকার উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন হয়ে যান বিল ক্লিনটন এবং বৃটেনে এনটনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার হয়ে যান টনি ব্লেয়ার। একই ধারায় বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন হয়েছেন ডেভিড ক্যামেরন এবং বর্তমান বৃটিশ বিরোধীদলীয় নেতা এডওয়ার্ড স্যামুয়েল মিলিব্যান্ড হয়েছেন এড মিলিব্যান্ড!
কিন্তু নাম বদলে ফেললেও তিনি যে উচ্চবংশীয় অভিজাত পরিবারের সন্তান সেটা গোপন করা অসম্ভব ছিল। তাই তিনি এক সময়ে বলেন, ‘যে উচ্চ শ্রেণীর মানুষরা বৃটেন চালায় তাদের আপাদমস্তক আমি জানি। তারা কিসের তালে আছে সেটাও আমি জানি। আর এটাই হচ্ছে লেবার পার্টিতে আমার অবদান।’
১৯৪৯-এ তিনি বিয়ে করেন আমেরিকান ধনী নারী ক্যারোলাইন মিডলটন ডিক্যাম্পকে। ক্যারোলাইন বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে এবং কাজ করতেন শিক্ষা ক্ষেত্রে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময়ে টনি বেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। এর নয় দিন পরে অক্সফোর্ডে একটি পার্কের বেঞ্চে ক্যারোলাইনকে পাশে বসিয়ে টনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। টনি বেন বলেন, ‘আমি খুব লাজুক ছিলাম।’ তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল এবং তারা এক কন্যা ও তিন পুত্রের জন্ম দেন। পুত্রদের মধ্যে মধ্যমজন হিলারি রাজনীতিতে এসেছেন এবং লেবার সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। অর্থাৎ, চতুর্থ পুরুষেও বেন পরিবার থেকে এমপি ও মন্ত্রী হয়েছেন। টনি বেন ও তার স্ত্রী বসবাস করতেন পশ্চিম লন্ডনে নটিং হিল এলাকায় একটি বড় বাড়িতে, যেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল লাইব্রেরি। ২০০০-এ ক্যারোলাইন মারা যান। যে বেঞ্চে বসে টনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই বেঞ্চটি তিনি অক্সফোর্ড থেকে কিনে লন্ডনে নিজের বাড়ির বাগানে স্থাপন করেন।
যুদ্ধবিরোধী বেন
১৯৪৯-এ বিয়ের পরপরই টনি বেন বৃস্টল সাউথ-ইস্টের এমপি হবার জন্য কাজে লেগে যান। ওই আসনে লেবার এমপি ছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড কৃপস, যিনি রিটায়ার করেছিলেন। ২০০১-এ টনি বেন ৫১ বছর পার্লামেন্টে সদস্য থাকার পর রিটায়ার করেন। রিটায়ার করার সময়ে তিনি বলেন, ‘আমি পলিটিক্সে আরো সময় দেওয়ার জন্য রিটায়ার করছি।’
কথাটা টনি বেন হালকাভাবে বলেননি। যখন মার্চ ২০০৩-এ ইরাকের বিরুদ্ধে বৃটেন যুদ্ধে যায় তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার। টনি বেন বলতেন, ‘প্রতিটি যুদ্ধই হচ্ছে কূটনীতির ব্যর্থতার পরিচয় (All war represents a failure of diplomacy)।’ তাই ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ টনি বেন চলে যান বাগদাদে এবং সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে আসন্ন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। তিনি মনে করতেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। আমেরিকার সহযোগী হবার জন্য তিনি ব্লেয়ারের সমালোচনা করেন।
টনি বেনের যুদ্ধবিরোধী হবার কারণ ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এয়ার ফোর্স পাইলট রূপে তিনি যুদ্ধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা স্বচোখে দেখেছিলেন। এই যুদ্ধে একটি দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই নিহত হয়েছিলেন। তাই ১৯৫৪ থেকে তিনি পারমাণবিক বোমাবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন। ২০০১-এ তিনি আফগানিস্তান যুদ্ধে বৃটেনের জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেন।
বাগদাদ থেকে ফিরে এসে টনি বেন ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ স্টপ দি ওয়ার কোয়ালিশন (যুদ্ধ থামাও জোট) নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ওই মাসে বৃটেনে যুদ্ধবিরোধীদের একটি মহাসমাবেশে বহু মানুষ যোগ দেয়। এতে পুলিশের মতে ৭৫০,০০০ প্রতিবাদকারী মানুষ উপস্থিত ছিল এবং সেই সময় পর্যন্ত সেটাই ছিল বৃটেনের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। দি ওয়ার কোয়ালিশন দাবি করে সেখানে ১,০০০,০০০ প্রতিবাদকারী উপস্থিত ছিল। টনি বেনের আবেগি কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা এই সমাবেশের সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল। পার্লামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আমৃত্যু এই জোটের হয়ে যুদ্ধবিরোধী কাজ চালিয়ে যান।
বিনয়ী বেন
প্রায় ৫১ বছর পার্লামেন্টের সদস্য থাকলেও এবং তার দল লেবার পার্টি একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও টনি বেন কখনোই প্রধানমন্ত্রী হননি- এমনকি লেবার পার্টি বিরোধী অবস্থানে গেলেও তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেননি। তাই টনি বেন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সব রাজনৈতিক জীবনই ব্যর্থতায় শেষ হয়। আমার রাজনৈতিক জীবন অধিকাংশের তুলনায় আগেই শেষ হয়েছে (All political careers end in failure. Mine ended earlier than most)।’
এই উক্তিটি ছিল তার বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেতা না হতে পারলেও তিনি লেবার সরকারের আমলে একাধিকবার মন্ত্রীর সমমর্যাদাসম্পন্ন পদে অথবা মন্ত্রী পদে কাজ করেছিলেন। তিনি হয়েছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল (১৯৬৪-১৯৬৬), টেকনলজি মন্ত্রী (১৯৬৬-১৯৭০), শিল্পমন্ত্রী (১৯৭৪-১৯৭৫) এবং এনার্জি মন্ত্রী (১৯৭৫-১৯৭৯)।
টনি বেন সম্পর্কে বলা হয়, মন্ত্রী পদে থাকার পরে যে গুটিকয়েক পলিটিশিয়ান আরো বামপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। এতে তার সোশালিজম বা সমাজতন্ত্র মার্কসবাদের চাইতে বাইবেল দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিল তার মায়ের কারণে। এক সময়ে বৃটেনে উগ্র বামপন্থীদের বলা হতো বেনপন্থী বা বেনাইট (Bennite)।
চারটি শিক্ষা
মন্ত্রিত্বের পরে কেন তিনি আরো বামপন্থী হয়ে যান সে বিষয়ে টনি বেন বলেন, ‘আমি চারটি শিক্ষা পেয়েছিলাম। এক. জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলো কিভাবে আমলারা বা সিভিল সার্ভিস প- করে দেয়। দুই. লেবার পার্টি যে ধারায় চলছে সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তার ফলে পার্টির নেতা তার জমিদারির মতো পার্টিকে চালাতে পারেন। তিন. লেবার সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার্সদের এবং চার. মিডিয়ার যে ক্ষমতা আছে সেটা মধ্যযুগীয় চার্চের সঙ্গে তুলনীয়। সমাজে যারা অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই মিডিয়া প্রতিদিনের ঘটনাগুলো দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করে।
এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে টনি বেনের এই চারটি শিক্ষা বিবেচনা করতে পারেন।
পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে
দেশের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরো প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য বেন ছিলেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার পক্ষে। দলের মধ্যে তিনি আরো গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। বৃটেনে প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলন বা কনফারেন্স হয়। বেন চাইতেন ওই সম্মেলনে ভোটের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন। ইইউ বা ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে বৃটেনের যোগদানের বিরোধী ছিলেন বেন। এই ইসুতে টনি বেন ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট পলিটিশিয়ান এবং নিজের দল লেবার পার্টির চাইতে প্রতিপক্ষ দল টোরি পার্টির কাছাকাছি।
টনি বেনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার দলের মূলধারার সঙ্গে বহুবার তীব্র বিরোধিতা ঘটেছিল। যেমন, ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান ইসুতে, কিন্তু তিনি কখনোই দল ছেড়ে যান নি। তিনি বলতেন, ‘দলের মধ্যে থেকেই দলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। কোনো ব্যক্তির অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল টেকে না।’
বাংলাদেশে বিদ্রোহী অঙ্গ দল গঠনের প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে তাদের উচিত হবে টনি বেনের পূর্ণ জীবনী পড়ে দেখা।
পরিশ্রমী লেখক
তাদের অসুবিধা হবে না। কারণ টনি বেন ছিলেন পরিশ্রমী ডায়রি লেখক। তার জীবন কেন্দ্রিক আটটি ডায়রি প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ডায়রি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। নাম : এ ব্লেইজ অফ অটাম সানশাইন (A Blaze of Autumn Sunshine বা হেমন্তের কড়া সুর্যালোক)। এই চূড়ান্ত ডায়রিতে তিনি ২০০৭-৯ সালগুলোর ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। জীবনের হেমন্তকালে বা পড়ন্ত বেলায় এই দুই বছরে তিনি দেশ জুড়ে প্রায় আশিটি শহরে ঘুরে বেড়ান, ভাষন দেন, বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন এবং ওয়ান-ম্যান শো বা একক শো উপস্থাপন করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং তার বক্তৃতায় ঘৃণার চাইতে বেশি ব্যঙ্গরস, ক্রোধের চাইতে বেশি যুক্তি এবং কল্পকথার চাইতে বেশি বাস্তব সমাধানের রূপরেখা থাকত, তাই তার ভাষণ শুনতে সর্বত্রই অনেক শ্রোতা টিকেট কিনে আসত। বিশেষত তরুণরা।
একটি স্ট্রোকের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষ ডায়রিতে তিনি লেখেন, ‘আমি আশা করি আবার আমি একাই চলাফেরা করতে পারব। আমি পরনির্ভর হয়ে থাকতে চাই না।... এই ডায়রিতে আমি লিখেছি কিভাবে মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। এই রূঢ় বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়েছে।’
এই আট খণ্ডের ডায়রি ছাড়াও আরো দুটি বই লিখেছেন। রেডিও এবং টেলিভিশনে বহু শো দিয়েছেন। টনি বেন লেখালেখির জন্য বিশাল লাইব্রেরি করেছিলেন যেখানে বইয়ের সঙ্গে ছিল অজস্র নিউজ পেপার ক্লিপিংস। এসব লেখা, শো, জনসভার ভাষণ এবং পার্লামেন্টে বিতর্কে বেন তার প্রতিপক্ষকে কখনোই অশোভন ভাষায় আক্রমণ করেন নি। তিনি বলতেন, প্রতিপক্ষকে তিনি ঘৃণা করেন না - প্রতিপক্ষের নীতিকে তিনি সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশে যারা বর্তমান ((অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভার ভাষণ শুনেছেন (‘আপনি (খালেদা) পেয়ারের পাকিস্তানে চলে যান’ ১ মে ২০১৪, গাজীপুর) তারা টনি বেনের কয়েকটি ভাষন পড়লেই বুঝবেন বাংলাদেশকে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ না হোক, মধ্যম সভ্যতার দেশে উন্নীত করতে হলে পলিটিশিয়ানদের ভাষা কেমন হওয়া উচিত।
টনি বেন কেন তার ভাষা ও ভাষণ সম্পর্কে এত সতর্ক থাকতেন? কারণ তিনি জানতেন প্রবীন পলিটিশিয়ানদের দ্বারা নবীন পলিটিশিয়ানরা প্রভাবিত হয়। বেন সবসময়ই নবীনদের কাছে পৌছাতে চেয়েছেন। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তরুণদের কথা শুনতেন। এটা শুধু যে তিনি ইংরেজ তরুণদের বেলায়ই করতেন, তা নয়। ষাটের দশকে আইয়ুব খান বিরোধী যেসব ছাত্রসম্মেলনে তিনি আসতেন তখন আমাদের কথাও তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং ভালো সাজেশন দিতেন। তার বই পড়ে এবং ভাষণ শুনে ছাত্রজীবনে ডেভিড ক্যামেরন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রাজনীতিতে যোগ দিতে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ক্যামেরন টোরি পার্টিতে যোগ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ক্যামেরন শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন টনি বেনের সৎ এবং আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি।
পপ ও পোশাক, চা ও পাইপ
তরুণদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র বজায় রাখতে টনি বেন খুব আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন পপ মিউজিকে। তিনি জানতেন রাজনীতির চাইতে তরুণরা মিউজিকে বেশি আগ্রহী। এ কারণেই প্রতি বছর তিনি ইংল্যান্ডের গ্ল্যাস্টনবেরি ফেস্টিভালে যেতেন। প্রতি জুনের শেষে সমারসেট, গ্ল্যাস্টনবেরিতে এই আন্তর্জাতিক উৎসবে পপ, ব্লুজ, রক, রেগে, হিপহপ এবং লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলে পাচ দিন ব্যাপী। পাশাপাশি চলে নাচ, নাটক, সার্কাস, ক্যাবারে মিউজিক এবং অন্যান্য ধরনের আর্টস প্রদর্শনী। বিশ্বের টপ পপ আর্টিস্টরা এই ফেস্টিভালে যোগ দেন এবং উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা পৌনে দুই লক্ষের বেশি হয়। টনি বেন বলতেন, ‘গ্ল্যাস্টনবেরি আমার জন্য একটা বার্ষিক তীর্ঘযাত্রা। এখানে এলে রাজনৈতিক তৃণমূলের সঙ্গে আমি পরিচিত হই। তরুণদের আইডিয়া জানি। নতুন শক্তি নিয়ে ফিরে যাই।’
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের কজন সিনিয়র পলিটিশিয়ান বাংলাদেশের কোনো পপ মিউজিক ফেস্টিভালে নিয়মিত গিয়েছেন কি? তারা কি জানেন, আসিফ আকবর, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ প্রমুখ পপ শিল্পীরা এখন কি গাইছেন? তারা কি জানেন, আর্টসেল, শূন্য, অর্থহীন, প্রভৃতি নতুন কোন পপ ব্যান্ড এখন তরুণদের মধ্যে প্রিয়?
ষাটের দশক কনওয়ে হলে তিনি আসতেন ক্যাজুয়াল পোশাক পরে। সাধারণত কালো অথবা ব্রাউন টাউজার্স এবং ব্রাউন কর্ডরয়ের জ্যাকেট পরে। তরুণদের সংস্পর্শে থাকার ফলে পরবর্তী সময়ে তরুণদের প্রিয় মালটিপকেট জ্যাকেট পরে তিনি সভায় যেতেন। তিনি ভেজিটারিয়ান বা নিরামিষাসী ছিলেন। কোনো এলকোহলিক ডৃংকস খেতেন না। অনবরত চা খেতেন। তার হাতে থাকত ধূমায়িত পাইপ। ইন্টারনেটে পাইপ হাতে টনি বেনের অনেক ছবি আছে। তবে কেউ কেউ বলেন, সবসময় হাতে পাইপ থাকলেও টনি বেন সবসময় পাইপ স্মোক করতেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে টনি বেন বলেছিলেন, “পাইপ স্মোকিং আমার নেশা নয় - ওটা পেশা... প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু তারপর সেই প্যাকেট বৈধভাবে কেনা যায়। বিষয়টা বেশ বিচিত্র।”
তরুণদের প্রতি
নিজের জীবনে একক সংগ্রাম চালিয়ে সফল হবার প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী টনি বেন তরুণদের প্রতি একটি মূল্যবান উপদেশ এবং আশার বানী দিয়ে গিয়েছেন। সেটা হলো, ‘প্রথমে তোমাকে ওরা অবজ্ঞা করবে। তারপর ওরা বলবে তুমি একটা পাগল। তারপর বলবে তুমি বিপজ্জনক। তারপর চলবে একটা নীরবতা। আর তারপর তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী কাউকে তুমি দেখবে না।’
তরুণদের যে কর্মসংস্থান দরকার সেটা টনি বেন বুঝতেন। তার যুদ্ধ বিরোধিতার এটাও একটা কারণ ছিল। তিনি বলেন, “যুদ্ধের জন্য যদি টাকা পাওয়া যায় তাহলে মানুষকে সাহায্য করার জন্যও টাকা পাওয়া সম্ভব... স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং সব ক্লিনিক ও হসপিটালে আরো বেশি লোক নিয়োগ করলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।”
পাচটি প্রশ্ন করবে
টনি বেন একজন চিন্তাবিদও ছিলেন। বিশেষত গণতন্ত্র বিষয়ে তিনি খুব সহজ ভাষায় তরুণদের প্রতি কিছু উপদেশ দেন। ২০০৫ সালে তিনি লেখেন :
ক্ষমতাশালীদের পাচটি প্রশ্ন করবে :
১ আপনার কী ক্ষমতা আছে?
২ এই ক্ষমতা আপনি কোনখান থেকে পেয়েছেন?
৩ কার স্বার্থে এই ক্ষমতা আপনি কাজে লাগাচ্ছেন?
৪ কার কাছে আপনি জবাবদিহি করেন?
৫ আপনাকে আমরা কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারি?
মনে রেখ :
ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার শুধু গণতন্ত্রই আমাদের দেয়।
সে জন্যই কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি গণতন্ত্র পছন্দ করে না।
আর সে জন্যই প্রতিটি প্রজন্মকে লড়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে এবং সেটা বজায় রাখতে।
এই প্রজন্মের মধ্যে তুমিও আছ, আমিও আছি - এখানে এবং এখনই।
এই উপদেশের অরিজিনাল ইংরেজিটা নিচে প্রকাশিত হলো। টনি বেন নিজের হাতে কয়েকটি শব্দ ক্যাপিটাল লেটারে লিখে আন্ডারলাইন করে দেন। আশা করি তরুণ পাঠকরা সেটা লক্ষ্য করবেন।
Ask the powerful five questions:
1 What power have you got?
2 Where did you get it from?
3 In whose interest do you exercise it?
4 To whom are you accountable?
5 How can we get rid of you?
- Tony Benn, 2005
Only democracy gives us that right.
That is why NO-ONE with power likes democracy.
And that is why EVERY generation must struggle to win it and keep it.
- Including you and me here and NOW.
টনি বেন তার একটি ডায়রিতে আরো তিনটি মূল্যবান উপদেশ নিয়ে গেছেন :
১ জনগণকে বিশ্বাস করো।
২ তুমি যা বিশ্বাস করো তার প্রতি সৎ থেকো।
৩ নিজের পরিবারের সঙ্গে থেকো।
বাংলাদেশে যখন রাজনীতি থেকে নীতি বিদায় নিয়েছে, সমাজ থেকে আদর্শ বিদায় নিয়েছে, শিক্ষায়তন থেকে মূল্যবোধ বিদায় নিয়েছে, তখন টনি বেনের এসব উপদেশ পলিটিশিয়ান, সমাজপতি ও শিক্ষাবিদরা প্রচারে উদ্যোগী হতে পারেন।
একাই একশ হতে পারে
৫ জানুয়ারি ২০১৪-র নির্বাচন বিহীন নির্বাচনে ইনডিয়া ব্র্যান্ড আওয়ামী লীগ “বিজয়ী” হবার পর এবং একজন (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকার পর তরুণ-প্রবীন কিছু রাজনৈতিক কর্মী-নেতা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা যদি টনি বেনের জীবন পর্যালোচনা করেন অথবা তার আত্মজীবনীমূলক ডায়রিগুলো পড়েন তাহলে তারা আবার আশাবাদী হবেন। পুনরুজ্জীবিত হবেন। তারা বুঝবেন মানুষ একাই একশ হতে পারে। একাই অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
আর সেখানেই (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ও তদীয় পুত্রের ভয়।
ইনডিয়ান সহযোগিতায় প্রতিটি দলের উপর নজরদারি করা যায়। দলের কিছু নেতাকর্মীকে ফাসি দেওয়া যায়। গুম করা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নজরদারি করা অসম্ভব। প্রতিটি ব্যক্তিকে গুম-খুন করা অসম্ভব।
ব্যক্তি যখন আদর্শে বলীয়ান এবং ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন কোনো সরকারের পক্ষেই তাকে সামলানো সম্ভব নয়। এটাই সত্য।
নারায়ণগঞ্জে সিরিয়াল অপহরণ, গুম ও খুন এবং তারপর শীতলক্ষ্যাতে সাতটি লাশ পাওয়ার পরে গত কয়েক দিনে সেই শহরে যে জনরোষ বিরাজ করছে সেসব এই সত্যটির প্রাথমিক প্রমাণ মাত্র।
ফিরে যাই সেই প্রথম প্রশ্নে।
টনি বেন কে ছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায় জানুয়ারি ২০০৭-এ বিবিসি-র দি ডেইলি পলিটিক্স প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত একটি জনমত জরিপে। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৩৮% -এর মতে বৃটেনের এক নাম্বার পলিটিকাল হিরো টনি বেন। মার্গারেট থ্যাচার পেয়েছিলেন ৩৫% ভোট।
এবার ফিরে যাবো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে। এই রচনার প্রথম তিনটি উদ্ধৃতিতে :
৩ টনি বেন আজীবন কর্মকাণ্ডে তার বানী বাস্তবায়িত ও সফল করে গেছেন।
২ তাজউদ্দীন আহমদ যে সতর্কবানী দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেটাও বাস্তবে ঘটে গিয়েছে।
১ সজীব ওয়াজেদ জয় যে আত্মবিশ্বাসমূলক নির্ভয়বানী দিয়েছেন সেটা কি বাস্তবে চলমান থাকবে? নাকি সেটা অবাস্তব ও ভুল প্রমাণিত হবে? ভবিষ্যতই সেটা বলে দেবে।
সূত্র- শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক, টিভি অ্যাঙকর, বিবিসির সাবেক কর্মী (১৯৫৭-১৯৯১), লন্ডনে বহুভাষাভিত্তিক স্পেকট্রাম রেডিও-র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও (১৯৮৭-১৯৯২)। fb.com/ShafikRehmanPresents