সিরিয়া - আমেরিকার রুটিতে রাশিয়ার পিঁপড়া
সিরিয়ায়
রুশ বাহিনীর বিমান হামলার পর
থেকে লক্ষণীয় যে, পুরো আরব
অঞ্চলে দ্রুত ‘শক্তি ভারসাম্যে’
পালাবদল ঘটতে শুরু করেছে। সোভিয়েত
ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর
বিশ্বের ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ বা
‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল;
আমেরিকার একক মোড়লিপনায় যে
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, আমার
প্রতীতি, তা আবার চ্যালেঞ্জের
মুখে পড়তে বসেছে।
যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর একান্ত নির্ভরশীল
আমেরিকার কূটচাল এবং তার
দোসরদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে
লাখ লাখ সিরীয় নারী-পুরুষ-শিশু দেশত্যাগে
বাধ্য হয়েছে, বাধ্য হয়েছে
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর করুণ
জীবন বেছে নিতে।
পশ্চিমা/ন্যাটোর বিমান হামলা, আমরা
দেখেছি, আইএসের ধ্বংসলীলা থামাতে
পারেনি; আসলে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের
ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং অস্ত্র বিক্রি
বাড়ানোই আমেরিকার মূল লক্ষ্য, তারা
আসলে আইএসকে থামানোর কার্যকর
কোনো চেষ্টাই করেনি; তাদের এই
নির্লিপ্ততার কারণেই সিরীয় শরণার্থীর
সমস্যা প্রকট আকার ধারণ
করেছে। তারা
যতটা আসাদবিরোধী ততটা আইএস বিরোধী
নয়; তারা বরং চেয়েছে
আইএসকে দিয়ে আসাদকে সরিয়ে
দিতে। আরবের
সম্পদ গ্রাসের লোভে মার্কিন জোট
চেয়েছে ইরাক ও লিবিয়ার
মতো সিরিয়ায় তাদের বশংবদ কোনো
গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা তুলে
দিতে। রাশিয়া,
চীন ও ইরাক যদি
আসাদকে সমর্থন না দিতো
তাহলে মার্কিন জোট তাদের খায়েশ
কবেই মিটিয়ে ফেলত! আসাদ
হতো সাদ্দাম নয়তো গাদ্দাফি!
মার্কিন
জোটের এই যুক্তিই তো
ভুয়া যে, আসাদ চলে
গেলে সিরিয়ায় শান্তি আর গণতন্ত্র
আসবে। কারণ
সাদ্দাম নেই, গাদ্দাফি নেই,
শান্তি আর গণতন্ত্র কী
এসেছে ইরাক ও লিবিয়ায়?
প্রতিদিন আমরা কেবল ওই
দুটি দেশে গৃহযুদ্ধে হতাহতের
খবর পাচ্ছি। কোথায়
উন্নয়ন, কোথায় স্থিতিশীলতা? এই
তো সেই আমেরিকা যারা
আরব ভূখণ্ডে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ডিভাইড অ্যান্ড
রুল’ পলিসি জারি রেখেছে
বহুদিন ধরে; শিয়া-সুন্নির
যুদ্ধংদেহী বিভক্তি, ইরানের ওপর হুমকি-ধমকি, আইএসের উত্থান
ও বিকাশ ঘটানো, আরব
ভূখণ্ডের এক বিস্তৃত অঞ্চল
আইএস যখন দখল করে
নিচ্ছে তখন দেখেও না
দেখার ভান করা- সবই
ওই পলিসির অংশ; আইএসের
বিকাশের পেছনে যে যুক্তরাষ্ট্র,
ইসরায়েল আর সউদি আরব
কাজ করেছে তা এখন
দুধের বালকও জানে।
আইএসকে দমনের ভান এখন
তারা করছে বটে কিন্তু
তার আসল ইচ্ছা আসাদ
রেজিমের পতন ঘটানো; এবং
আইএসকে বাড়তে দেওয়ার যে
সুযোগ তারা দিয়েছে তার
ভেতরেই আমরা খুঁজে পাবো
লাখ লাখ সিরীয়বাসীর শরণার্থীর
জীবন বেছে নেওয়ার রাজনৈতিক
নকশাটি। কিন্তু
এর মধ্য দিয়ে যে
প্যারাডক্সের জন্ম হয়েছে তাহলো
মধ্যপ্রাচ্যে ভুল মার্কিন নীতির
কারণেই ইরান সুযোগ পেয়েছে
সিরিয়ায় আইএস সুন্নিদের ওপর
হামলা চালাতে, একইভাবে সাদ্দাম হোসেনের সাবেক সেনারা সুযোগ
পেয়েছে আইএসের হয়ে লড়তে।
এই
যখন অবস্থা তখন আইএস
দমনে ইরানের পাশাপাশি রাশিয়ার
বিমান হামলা যুদ্ধের মোড়
মৌলিকভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়ার অব্যাহত আক্রমণে আইএস ইতিমধ্যে কাবু
হতে শুরু করেছে; মানুষ
বুঝে গেছে আইএস আসলে
অত শক্তিশালী নয়, মার্কিন/ন্যাটো
জোট চাইলে বহু আগেই
আইএসকে দমন করতে পারত;
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে চাওয়ার ক্ষেত্রে
মোটেও সৎ ছিল না,
তারা বরং আরবের ঘোলা
পানিতে মাছ শিকারের আশায়
ছিল। কিন্তু
সে আশার রুটিতে পিঁপড়ে
উঠিয়ে দিয়েছে রাশিয়া।
বাকি বিশ্ব আইএস লক্ষ্যস্থলে
রাশিয়ার হামলাকে তাই স্বাগত জানিয়েছে;
পেছনে আছে চীন।
কাজেই সে দিন খুব
দূরে নয়, যখন আমেরিকাকে
মধ্যপ্রাচ্য থেকে লেজ গুটাতে
হবে। পুতিন
কিন্তু সাবেক কেজিবি প্রধান,
সহজে ছাড়ার লোক হবেন
না তিনি- এই মেসেজটা
অন্তত পুরো পৃথিবীকে দিতে
তিনি সক্ষম হয়েছেন।
রাশিয়া জোট মধ্যপ্রাচ্যে এত
জোরালোভাবে কখনই নিজেদের এনগেইজড
করেনি, এ খেলায় সফল
হলে পুরো পৃথিবীতেই মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ বড় ধরনের ঝাঁকুনি
যে খাবে এটা নিশ্চিতভাবে
বলা যায়। আর
এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে
শক্তির ভারসাম্যের নতুন এক মেরুকরণের
আশু সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে বলেই
মনে হচ্ছে। মার্কিন
কর্তৃত্ব আর মোড়লিপনাই যে
শেষ কথা নয়, বিশ্বের
তাবৎ শান্তিকামী মানুষের মতো আমিও আত্মম্ভর
আশায় সেই বাস্তবতা দেখার
অপেক্ষায় আছি। লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
robaet.ferdous@gmail.com
সূত্র - রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ প্রতিদিন
0 comments:
Post a Comment