Monday, March 30, 2015

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী


গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (জন্ম : ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯২ এবং মৃত্যু : ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩) জনগণের প্রতি অসীম ভালোবাসা এবং গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাই ছিল তার জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দেশ ভাগের আগে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি অখণ্ড স্বাধীন বাংলা নামে একটি ‘ডমিনিয়ন রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক অর্জন করেন। এ ছাড়া সেখানে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে পদচারণ করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। প্রথমে তিনি যোগ দেন চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে। ওই দলটি তখন মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ ছিল। ১৯২৩-এর বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় খেলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মুসলমানদের মধ্যে তার ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সঙ্গে তিনি জড়িত হননি। ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি’ নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে এই দলটি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছরই দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ আছে, “এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমি লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তোললেন। ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলার বন্দোবস্ত করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন।”

১৯৪৬ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ এবং ‘পাকিস্তানের শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তার অনুসারীরা অনেকে ১৯৪৮-এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯-এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দুবছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানীর সঙ্গে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন : ১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২. মওলানা ভাসানী ও ৩. এ কে ফজলুল হক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসা¤প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫৪ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮০। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য ছিলেন মাত্র ১৪ জন। রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এই ১৪ জন পার্লামেন্ট মেম্বারের সমর্থনপুষ্ট সোহরাওয়ার্দীকে সে সময়কার পরিস্থিতির কারণে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ করিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে তিনি পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনের তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়।


এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৫৯ সালের আগস্ট থেকে ইলেক্টিভ বডি ডিসকুয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি হলেও ১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। পরদিন বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও মিটিং-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদির পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মন্ত্রীকে আক্রমণ ও তার গাড়ি ভাঙচুর করেন। তুমুল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খানের সামরিক আইন সারা দেশে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৬২ সালের ৮ জুন সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। ৬ মাস ২০ দিন কারাজীবনের অবসান ঘটিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পরই সোহরাওয়ার্দী দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তদানীন্তন নয়জন নেতাসহ দেশব্যাপী ঝটিকা সফর শুরু করেন। এ পর্যায়ে ১৯৬২ সালের শেষ ভাগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দেন। ওই বছরের অক্টোবরে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন।

0 comments:

Post a Comment