সালমানের হরিণ শিকার ও ফেলানী
ফেলানী র্হ্ত্যাকান্ড (রাষ্ট্রিয় নতজানু পররাষ্ট্র নীতির ফল) ও সালমানের হরিণ শিকার
বলিউডের নায়ক সালমান খান। তিনি শিকার করেছিলেন একটা বিরল প্রজাতির হরিণকে। ১৪ বছর আগে রাজস্থানে শুটিং করতে গিয়ে তিনি এই শিকারকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তাঁর বিচার হচ্ছে ভারতের আদালতে। শুধু সালমান খানের নয়, তাঁকে এই শিকারে উৎসাহিত করার অভিযোগে বিচার হচ্ছে সাইফ আলী খান, সোনালি বেন্দ্রে প্রমুখের। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সালমান খানের তিন বছর থেকে ছয় বছরের জেল হতে পারে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সংঘটিত এক হত্যাকাণ্ডের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছেন। কি বাংলাদেশে, কি বাংলাদেশের বাইরে, বিবেকবান মানুষের হূদয় বিদীর্ণ হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে আছে এক কিশোরী। তার পা ওপরের দিকে, চুল নিচের দিকে। তার গায়ে লাল রঙের শীতপোশাক, পরনে নীল বস্ত্র। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়ে সে ঝুলে ছিল অনেকক্ষণ। পরে জানা যায়, বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের এক গ্রামের মেয়ে ফেলানী। সে পড়ে ভারতের আসামের এক মাদ্রাসায়। ১৪ বছরের এই মেয়েটিকে তার বাবা দেশে ফিরিয়ে আনছিলেন বিয়ে দেবেন বলে। ছবিতেই দেখা যায়, বেড়ার গায়ে একটা বাঁশের মই। ওই মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরোনোর চেষ্টা করছিল ফেলানী। বাবা সীমানা পেরিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু মেয়েটিকে গুলি করেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য। রঙিন জামাসমেত ঝুলে থাকে এক শিশুর দেহ। ওই ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মানুষ। ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ক্ষোভ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ-ভারতের ২৪২৯ মাইল অভিন্ন স্থলসীমান্ত বেশ জটিল। অনেকগুলো ছিটমহল আছে, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন হয়নি, এমন জায়গা আছে। আমি আখাউড়া এলাকায় এমন বাড়ি দেখেছি, যার একটা ঘর পড়েছে ভারতে, একটা ঘর বাংলাদেশে। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বিয়েশাদি হয়েছে, আত্মীয়স্বজন আছে, সীমান্ত হাটগুলোতেই বোঝা যায়, আদান-প্রদানও আছে। ফেলানী নিজেই সাক্ষী যে বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবৈধ পথে ভারতে যায়। আবার ভারতীয়রাও বাংলাদেশে আসে। আমি কক্সবাজারে একজন রিকশাওয়ালা পেয়েছিলাম, তাঁর কথার সুর ও স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি হয় খুবই শিক্ষিত, নয়তো এ দেশের নন। খানিকক্ষণ আলাপের পর তিনি জানালেন, তাঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে, সমুদ্র দেখার জন্য তিনি চলে এসেছেন কক্সবাজারে, এখন রিকশা চালিয়ে খরচ তুলছেন। ঢাকায় বহু ভারতীয় নাগরিক কাজ করছেন, যাঁদের অনেকেরই হয়তো ওয়ার্ক পারমিট নেই। অন্যদিকে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ে স্পর্শকাতরতা আছে। বেশ কটা জঙ্গি হামলা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে, মুম্বাই হামলা থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা। তারা সীমান্তকে নিশ্ছিদ্র করতে চায়। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের যে বৈশিষ্ট্য, তাতে কথায় কথায় গুলি চালানো হবে সবচেয়ে অবিবেচকের কাজ। কেবল শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের সীমান্তেই দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। অনেকে বলেন, দুই দেশের সীমান্তে যত হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার মূলে রয়েছে চোরাচালান ও দুর্নীতি। কেবল বখরার গন্ডগোল হলেই গুলি চলে। দুই দেশের মধ্যে স্থলবাণিজ্য যত সহজ, যতটা বৈধ করা যাবে, এই সমস্যার সমাধান ততই অর্জনযোগ্য হয়ে উঠবে। আর দরকার ছিটমহল বিনিময়, সীমানা চিহ্নিত করা। ছিটমহল বিনিময় কেন হচ্ছে না, কোন পক্ষ এটা আটকে রেখেছে, আমরা জানি। ভারতের সংসদে এটা অনুমোদন করা হচ্ছে না। ৬৬ বছর পেরিয়ে গেল, ছিটের মানুষেরা রাষ্ট্রহীন হয়েই রইল। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও তাই চায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত জনমত জরিপে আমরা দেখেছি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হোক, এটা এই দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই চাওয়া। ভারতের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া ছিল তাদের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করা, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা। বাংলাদেশ স্পষ্টভাবেই অবস্থান নিয়েছে, বাংলাদেশের মাটিকে ভারতবিরোধী জঙ্গি তৎপরতার জন্য ব্যবহূত হতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ অতিবিখ্যাত তিতাস নদের ওপরে মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করে ভারতে ভারী পণ্যবাহী যান চলাচলে সাহায্য পর্যন্ত করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে যখন এলেন, তখন ব্যাপক আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে অন্তত তিস্তা নদীর পানি বিনিময় চুক্তি হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসলেন, মনমোহনের সফরসঙ্গী হলেন না। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হলো না। ওই সময় আমি এই কলামে লিখেছিলাম প্রিন্স মাহমুদের একটা গানের কথা, দু পা আমি এগিয়েছি, দু পা তুমি পিছিয়েছ, এভাবে ভালোবাসা হয় না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানুষ হত্যা শূন্যে আনা হবে, নেতৃত্বের পর্যায়ে এ কথা অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। মনমোহন সিং বাংলাদেশে যখন এসেছেন, তখন হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত বিএসএফ-বিডিআর বা বিজিবি পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে, মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে, সচিব পর্যায়ের বৈঠকে হয়েছে। সীমান্তে লোক অবৈধভাবে যাতায়াত করলে উভয় দেশের বাহিনী বাধা দেবে, বলপ্রয়োগও করতে পারে; কিন্তু গুলি হওয়া উচিত একেবারে শেষতম অস্ত্র, কেবল জঙ্গি, ডাকাত, আক্রমণকারীদের ওপরেই যা ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব কথা যখন ঢাকায় কিংবা দিল্লিতে উচ্চারিত হয়, উভয় পক্ষই একমত হয়, আর সীমান্ত হত্যা নয় বলে অঙ্গীকার শোনা যায়, ঠিক তখনই সীমান্ত থেকে খবর আসে, আবারও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বিএসএফ কর্তৃক ৯৫ জন, ২০০৭ সালে ৮৭ জন বাংলাদেশি নিহত হন, তুলনায় ২০১১ সালে ৪৮ জন মারা যান। ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড যদি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে একটা দৃষ্টান্ত তো স্থাপন করতে হবে। ফেলানীর মামলাটা হতে পারত সেই দৃষ্টান্ত। ফেলানী শিশু, ফেলানী নারী। মই বেয়ে যেভাবে সে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকছিল, তাতেই স্পষ্ট, সে চোরাকারবারি নয়, জঙ্গি দলের সদস্যও নয়। তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। সে কাউকে গুলি করেনি। সম্মিলিত চোরাকারবারিদের মতো লাঠি হাতে তেড়েও আসেনি। তাকে গুলি করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। তার পরেও গুলি হয়েছে। বালিকার দেহ জর্জরিত হয়েছে। তার নিস্পন্দ দেহ ঝুলে থেকেছে কাঁটাতারের বেড়ায়। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এবং ঘোষণা এসেছে, এই প্রথম সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বিএসএফের কোনো একজন সদস্যের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন এই খবরের ফলোআপ খবর ছাপা হয়েছে। ফেলানীর বাবা সাক্ষ্য দিতে ভারতে গেছেন। সবার দৃষ্টি যখন বিচারের রায়ের দিকে, তখন আমরা জানতে পারলাম, অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ পর্যন্ত বলেছে, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। কারণ, বিচার হয়েছে বাহিনীসমূহের বিশেষ আদালতে, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে, ফৌজদারি আদালতে নয়। এই রায় কী বার্তা দিচ্ছে? যে বার্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় ঘোষিত হয়েছিল, যে বার্তা বিভিন্ন স্তরের বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকে বারবার উচ্চারিত হয়েছে, আর সীমান্ত হত্যা নয়, সীমান্তে আর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটবে না, একেবারে নিজেদের ওপরে আঘাত না এলে গুলি করা হবে না। সেই বার্তাসমূহ একেবারে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া হলো। এখন বিএসএফ সদস্যরা এই বার্তাই পেলেন যে একটা ১৪ বছরের নিরস্ত্র কিশোরীকেও গুলি করা চলে এবং তাতে কোনো সাজা হয় না, দোষ হয় না। দুটি দেশ, যারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর, কাগজ থেকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য রাজনৈতিক পর্যায়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, সেখানে এর চেয়ে ভয়ংকর বার্তা আর কী হতে পারে? বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার এক বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, বিচার শেষ হয়নি, এই রায় রিভিউ হবে, দোষীরা অবশ্যই উপযুক্ত সাজা পাবে। এখনই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া তাই দেখানোর সময় নয়। আমরা বলব, এখনই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়। ভারত এই বিচার উন্মুক্ত ফৌজদারি আদালতে আনুক। আমরা জানি, সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। কালকেও টেলিভিশন খবরে দেখলাম, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর লাশ পড়ে আছে সীমান্তে। এই হত্যাকাণ্ড যদি বন্ধ করতে হয়, অন্তত কমিয়ে আনতে হয়, ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হতে পারে উদাহরণ। সেটা বিপরীত উদাহরণ সৃষ্টি করলে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। বিএসএফ সদস্যরা গুলি করতে উৎসাহিত বোধ করতে পারেন। তরুণ লেখক আসিফ এন্তাজ তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন: পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। একটা বাঘ হত্যা করলে, সেটার জন্য বিচার হয়। জেল হয়, জরিমানা হয়। একটা পাখি গুলি করে মেরে ফেললে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এমনকি একটা গাছ কেটে ফেললেও সেটার জন্য শাস্তি পেতে হয়। শুধু ‘গরিব মানুষ’ মারলে ছুই হয় না। সত্যি তো, হরিণ শিকার করার জন্য সালমান খানের মতো তারকার বিচার হচ্ছে, অথচ ফেলানী হত্যাকাণ্ডে বিচারে কারও সাজা হবে না? বাংলাদেশের মানুষের মনে ফেলানী হত্যাকাণ্ডে বিচারের রায়ের খবর গভীর ছায়া ফেলেছে। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য যা মোটেও ভালো খবর নয়।
সূত - প্রথম আলো, আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সূত - প্রথম আলো, আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment